বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবচেয়ে পুরনো বাজার শ্যামবাজার। এখানকার আড়তগুলোর জৌলুস এখনো টিকে আছে।
১৭৪০ সালে ঢাকার নায়েবে নাজিম নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের সময় ফরাসি বণিকদের প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট্ট ‘গঞ্জ’ বা ‘বাজার’ কালক্রমে আজকের বৃহৎ শ্যামবাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। একসময় ফরাসি অধ্যুষিত পুরো এলাকাটি ফরাশগঞ্জ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। পরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আড়তদারির উত্থানের ফলে শ্যামবাজারের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্রই। কৃষিপণ্য বেচাকেনার সবচেয়ে বড় আড়ত ও বাজার হিসেবে শ্যামবাজার গড়ে ওঠারও একটি ইতিহাস রয়েছে। শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় শুধু নৌপথে বিক্রমপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, সিলেট থেকে কৃষিপণ্য আসত শ্যামবাজার ঘাটে। বর্তমানে খেয়ানৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার শ্যামবাজার ঘাটের জায়গা দখল করে নেওয়ায় সড়কপথে ট্রাক, বাস, টেম্পো প্রভৃতি দিয়ে মালামাল আনা হয়। সড়কপথে শ্যামবাজারের আড়তগুলোর সঙ্গে সহজ যোগাযোগের পথ ঐতিহাসিক বাকল্যান্ড বাঁধের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশও দখলে রেখেছে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকান। জানা যায়, রূপলাল হাউসের পুব দিকে রঘুনাথ দাস একটি বাগান গড়ে তুলেছিলেন; যা পরে সবজিবাগান হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সবজিবাগানের নাম ছিল সবজিমহল। ওই বাগানের সঙ্গেই ছিল একটি সেতু। এ সেতুটিকে বলা হতো শ্যামবাবুর পুল। শ্যামবাবু ছিলেন ঢাকার খ্যাতনামা জমিদার ও রূপলাল দাসের ভাই সনাতন দাসের ছেলে। একপর্যায়ে বিশাল এই সবজিবাগান নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে ধীরে ধীরে একটি বাজার বসতে শুরু করে। শ্যামবাবুর পুলের পাশে গড়ে ওঠা বাজারটিই আজকের শ্যামবাজার। ১৯৫৬ সালের দিকে এটি আনুষ্ঠানিক বাজারে পরিণত হয়। এ সময় প্রতিষ্ঠিত শান্তি সমিতি নামে একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গার তীরে বাকল্যান্ড বাঁধসংলগ্ন ১৩টি আড়ত দিয়ে ৩২ জন ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের পাইকারি বেচাকেনা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালের দিকে ঢাকার সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও বড় কৃষিপণ্য বেচাকেনার আড়ত ছিল ইমামগঞ্জ আর জিঞ্জিরায়। ১৯৭১ সালের পর থেকে ইমামগঞ্জ ও জিঞ্জিরার জৌলুস কমতে থাকে। অন্যদিকে জমতে থাকে শ্যামবাজারের আড়তগুলো। একপর্যায়ে ইমামগঞ্জ ও জিঞ্জিরার ব্যবসায়ীরা শ্যামবাজারে চলে আসেন। ফলে এখানে গড়ে ওঠে দেশের সর্ববৃহৎ পাইকারি কৃষিপণ্য বেচাকেনার আড়ত। এ সম্পর্কে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়তদার হাজী আবদুস সামাদ এই প্রতিবেদককে জানান, এ বাজারে অবস্থিত প্রায় ২৫০টি আড়তে মাসে ১০০ কোটি টাকার ওপরে কৃষিপণ্য বিক্রি হয়। শ্যামবাজার থেকে তরিতরকারি, পিয়াজ, রসুন, আদা, আলু, হলুদ, মরিচ, ধনে, পান-সুপারি, মালাই খয়ের, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, লেবু প্রভৃতি কৃষিপণ্যের পাইকারি কেনাবেচা হয়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হয়। মহিউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, এখানকার বহু মানুষ বৈধভাবে ব্যবসা করলেও আড়তগুলোর স্থায়ী বরাদ্দ পাননি। পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাড়িঘরে আড়তগুলোর অবস্থান। তারা সেগুলো ব্যবহারের জন্য সরকারকে নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করছেন। এর পরও কেন ব্যবসায়ীদের স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে না? সরেজমিন দেখা যায়, লালকুঠির ঘাট থেকে শ্যামবাজারের পূর্বাংশ পর্যন্ত (কচুঘাট) বেড়িবাঁধ সড়কে শামিয়ানা কিংবা ত্রিপল টানিয়ে বসেছে তিন শতাধিক কাঁচামালের দোকান। এসব দোকানের কারণে এই সড়কে রিকশাও চলাচল করতে পারে না। এ সড়কটির প্রস্থ প্রায় ১৫ ফুট। এ ছাড়া এসব দোকানের বর্জ্য কয়েকজন দোকানিকে বুড়িগঙ্গায় ফেলতে দেখা গেছে। এতে নদীর এই অংশে বর্জ্য স্তূপ হয়ে আছে।