১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশালে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের কাছে সম্ভ্রম হারানো হাজারো বীরাঙ্গনার তথ্য নেই মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যাদের ত্যাগের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছিল বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেইসব বীরাঙ্গনাদের খোঁজ আর কেউ রাখেনি। অথচ, এইসব বীরাঙ্গনাকে বীরমাতা উপাধি দিয়ে তাদের সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর হলেও সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীরাঙ্গনাদের তালিকা করে তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলেছেন। এরইমধ্যে হানাদারদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার বীরাঙ্গনাদের অনেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই লোক লজ্জার কারনে সেইসব ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে চান না। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা এখনো রোগে-শোকে ধুকে বেঁচে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আশার আলো দেখছেন তারা।
তেমনই একজন মৃত্যুপথযাত্রী বীরাঙ্গনা বরিশাল নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আলেকান্দার হালিমা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকটা নিভৃতে ধুকে ধুকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে যাচ্ছেন। বীরাঙ্গনা হালিমার ছেলের বউ রহিমা বেগম জানান, হানাদারদের নির্মম নিষ্ঠুরতার ঘৃনা-কষ্ট নিয়েই সারাটি জীবন কাটিয়েছেন তার শ্বাশুড়ী আর নিরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলেছেন। ৬ বছর আগে হৃদ রোগে (স্ট্রোক) আক্রান্ত হয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। থাকেন অন্যের জমিতে পরগাছার মতো। জোটে না তিন বেলা খাবার, চিকিৎসা।
দেরীতে হলেও সরকার বীরাঙ্গনাদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়ায় অন্ধকারের মধ্যে আলো দেখছেন হালিমার পরিবার। এতদিন লোক লজ্জায় মায়ের সম্ভ্রম হারানোর কথা কাউকে না বললেও সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে হালিমার ছেলে নান্না কাজী বলেন, সরকারের কাছে এখন তাদের দাবি শুধু একটু চিকিৎসা ও বাসস্থান।
হালিমার মতো হাজারো নারীকে পাক বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম হারাতে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বরিশালে পাক হানাদার ক্যাম্পের কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদামের (সিএসডি) ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী হাকিম আলী সরদার। নিজের চোখে দেখা দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তার দু'চোখ ভিজে ওঠে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার শেখ কুতুবউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, তার জানা মতে বরিশালে ২/৩ জন বীরাঙ্গনা আছে। এর বাইরে অনেকের কথা শুনলেও লোকলজ্জা-সামাজিকতার কারণে অনেকেই সেই কালো অধ্যায়ের কথা স্বীকার করতে চান না। তার মতে, অকৃতজ্ঞ এই জাতির উচিত ছিল অনেক আগেই তাদের সন্মান জানানো।
মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. মোকলেছুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বীরাঙ্গনাদের তালিকা করা অত্যন্ত কঠিন। এটা করতে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরতে হবে, এতে অনেক টাকার দরকার। আর আমলাতান্ত্রিকতার কারণে এ তালিকার স্বচ্ছতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম বলেন, বীরাঙ্গনাদের তালিকা তৈরির কোন নির্দেশনা তিনি পাননি। সরকার নির্দেশনা দিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সে আদেশ পালন করা হবে। তিনি বলেন, বীরাঙ্গনাদের তালিকা করার চেয়েও তাদের মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়াই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/১০ ডিসেম্বর ২০১৪/আহমেদ