৯ জানুয়ারি ১৯৭২, ভোর ছয়টা। লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। ৩০ মিনিট ধরে চলে ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোন আলাপচারিতা। ঘণ্টাখানেক পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রাপথে সহযাত্রী হলেন ব্রিটেনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন, সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন।
বিমানে তাঁরা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উৎফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না।
আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিন তাকে সহযোগিতার জন্য। বললেন, ‘ব্যানার্জি, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ শশাঙ্ক বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীর লয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ তাঁরা দুজনে মিলে গানটা গাইলেন। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’
শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, ‘দিল্লি অবতরণের তখন আর সময় বেশি বাকি নেই। পাইলট আমাদের দুটি ছবি তুলে দিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তোলা সেই ঐতিহাসিক ছবিটি এখনো খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি।’ দিল্লিতে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরণ সিংসহ আরও অনেকে। রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য কলকাতা থেকে আনা গুড়ের সন্দেশ, সমুসা, শিঙ্গাড়া আর দার্জিলিং চা তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। দুপুরে বিমান থেকে ঢাকায় নামলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনস্রোত আর মানুষের স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। সোচ্চার ধ্বনি উঠছে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’। বিমানবন্দর থেকে পল্টন ময়দান—এক বিপুল জনসমুদ্র। শশাঙ্ক বলেন, ‘সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত, চারদিকে মুক্তি আর মহানেতাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আজও চোখে লেগে আছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি।’
বাংলাদেশের সফল অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আব্দুল মুহিতের হিষ্টোরি অব বাংলাদেশ - সাব কন্টিনেন্টাল সিভিলাইজেশন বইয়ের ৩১০ নং পাতায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখেছেন - ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের দিল্লী পৌছান ব্রিটিশ সরকারের দেয়া বিশেষ বিমানে। তাকে দিল্লীতে স্বাগতম জানান, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। একই দিন বিকালে তিনি বাংলাদেশে পৌছান তখন হাজার হাজার জনতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা তাকে স্বাগতম জানান। জাতি তাদের প্রিয় নেতাকে ফিরে পেলো, যিনি দেশের কান্ডারী। এটাই বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ বেচে ফেরা, তার আগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে খালাস পেয়ে প্রথমবার বেচে ফেরা, আর ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসের শুরুতে পাকিস্তানে বন্দী থাকা অবস্থায় লালপুর বিশ্বাসঘাতকতা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়া।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল