অর্থনীতি এখন কোন পথে? ব্যবসা-বাণিজ্য কি মন্দায়? শিল্প-উদ্যোগ-বিনিয়োগে স্থবিরতা আর কত দীর্ঘায়িত হবে? অর্থনীতির শ্বেতপত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন? এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অধ্যাপক ড. বিরূপাক্ষ পাল।
প্রশ্ন : অর্থনীতি একটা ক্রান্তিকাল পার করছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
উত্তর : অর্থনীতির দুটি পাপ থাকে। একটি হচ্ছে বেকারত্ব আরেকটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বেকারত্ব হচ্ছে একটি মধ্যমেয়াদি সমস্যা।
রাতারাতি এর সমাধান করা যায় না। আর মূল্যস্ফীতিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হয়। এই দুটি পাপই সব সময় সরকারকে খেদায়। এটা আমেরিকায়ও হয়। যদি এই দুটি বেড়ে যায়, তাহলে সরকার অজনপ্রিয় হয়ে যায়।
বাংলাদেশে যে কোটা আন্দোলন হলো এটাও কিন্তু বেকারত্বের ফসল। এটা বেড়েছিল বলেই ছাত্ররা হতাশাগ্রস্ত হয়েছে। তারা চাকরি পাচ্ছিল না।
এ জন্য আন্দোলনে শামিল হয়েছে। আর বাংলাদেশ সরকারকে আরো অজনপ্রিয় করেছে কভিডের সময় থেকে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তারা ওই সময় বেপরোয়াভাবে টাকা ছাপিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারের অযোগ্যতা বা ফিজিক্যাল গ্যাপটাকে পূরণের চেষ্টা করেছে। এখন এই দুটি বিষয়ের সমাধান করতে হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি করলে মানুষ কিছু না কিছু কাজ দেবে। মানুষ যদি দুটি দোকানও করে, সেখানেও কিন্তু দুজন লোকের কাজের সুযোগ হয়। আমাদের দেশে তো অর্থনৈতিক কার্যক্রম ৮৫ শতাংশ ইনফরমাল খাতে হয়। আর ১৫ শতাংশ হয় ফরমাল খাতে। বেকারত্বের সমাধান যদি করা যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি থাকলেও তা সহনীয় থাকে। কারণ তখন মূল্যস্ফীতি থাকলেও মানুষ যেহেতু কাজ পাচ্ছে, তাই সে কিনতে পারছে। তখন তার বেতন বাড়ছে, সে বাজারে গিয়ে কিনতে পারছে। এই সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরে প্রথম মনোযোগটা দরকার ছিল এই দিকে। আর অর্থনীতির দুর্বল হওয়ার আরেকটা কারণ ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। নতুন সরকার এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এটা হতে পারে। যেদিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার ছিল তা হলো ব্যবসা-বাণিজ্যটাকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দেওয়া উচিত ছিল। বিকল্প তৈরি না করে সব কিছুর মধ্যে একটা প্যানিক সৃষ্টি করা উচিত হয়নি। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যটা থমকে গেছে আর চাঁদাবাজি বেড়েছে। চাঁদাবাজিটা রাজনৈতিক কারণে হয়, কারণ অনেকে অভুক্ত ছিল গত ১৫ বছরে। তারা চাঁদাবাজি শুরু করেছে, যার জন্য সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যটা খারাপ হয়েছে এবং শিল্প মালিকরা ছাঁটাই শুরু করেছেন। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়া মানে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। বাংলাদেশ এমন কোনো বিপর্যয়ে যায়নি যে সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে।
প্রশ্ন : সরকার কি ঠিকমতো মনোযোগ দেয়নি?
উত্তর : যদি বৈশ্বিক মন্দা শুরু হয়ে যেত তাহলে মানা যেত। বরং বিশ্ব অর্থনীতিটা এখন ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাচ্ছে। অর্থনীতির দিকে মনোযোগটা না বাড়ানোয় সংকট বেড়েছে। এর ফলে কিছু রাজনৈতিক, কিছু আদর্শিক, কিছু নৈতিক প্রশ্ন, কিছু ভাষাগত সংযোজন-বিয়োজন সেগুলোর পেছনে মনোযোগগুলো চলে গেছে। আর কিছুটা মব সংস্কৃতির কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। তাতে ব্যবসায়ীরা যা কিছু ব্যবসা করত, তাতেও স্থবিরতা এসেছে। আর নতুন বিনিয়োগও হয়নি। এর ফলে অর্থনীতিতে দুই পাপ যেটাতে শুরু করেছিলাম সেটা প্রলম্বিত হয়েছে। এতে বেকারত্ব বেড়েছে। সরকার নিজে কোনো জরিপ না করলেও অন্য জরিপ থেকে দেখা যায় যে বেকারত্ব বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি খুব না বাড়লেও সহনীয় মাত্রায় আসেনি। সুতরাং মোটাদাগে বলা যায়, এই দুটি জায়গায় উন্নতি হয়নি। মানে হলো অর্থনীতির এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয়। সরকারের যদি ইতিবাচক কিছু দেওয়ার ক্ষমতা না-ও থাকে, তার পরও উচিত ছিল যাতে নেতিবাচক কিছু না হয়। মানে ‘ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও’-এর মতো অবস্থা আর কি।
প্রশ্ন : জিডিপি প্রবৃদ্ধি কি ঠিক পথে আছে?
উত্তর : জিডিপি মূল বিষয়। জিডিপি বাড়ল কি কমল এটা করিমন নসিমনদের কিছু যায় আসে না। এরা কাজ পেতে চায়। এরা রাইস মিলে যেতে চায়। যেকোনো মূল্যে তাদের আয়টা বাড়াতে চায়। ডাল-ভাত খেতে চায়। আগে যেমন তারা খেত। আর অপেক্ষা করতে চায় কবে নির্বাচনটা হবে, নতুন সরকার আসবে। তখন হয়তো এরা বুঝতে পারবে একটা পরিবর্তন হবে। সে জায়গাটায় সরকারের মনোযোগ বিক্ষিপ্ততা রয়েছে। অর্থনীতির যদি দুই পাপের কথা হিসাব করি, এই দুই পাপের ইন্ডিকেটর কোনোটাই ভালো নয়। মানুষ বলছে, ইনফ্লেশনটা যদিও বাড়েনি কিন্তু চরম আর উচ্চস্তরেই রয়েছে।
প্রশ্ন : শ্বেতপত্র নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
উত্তর : আমার পর্যবেক্ষণ হলো সরকার আসার পর দুটি বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছে। একটি হলো শ্বেতপত্র রচনা। বিগত সরকারের সময়ে যে অন্যায়গুলো হয়েছে সেটা বের করা। এ কাজটি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। শ্বেতপত্র রচনাটি অত্যন্ত দ্রুত তৈরি করা হয়েছে। শ্বেতপত্র নিজেকে হাস্যকর করেছে কিছুটা। যেমন—বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন যে সেভেনটিন বিলিয়ন ডলার চলে গেছে। আবার গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে যে বছরে তিন-চার বিলিয়ন ডলার পাচার হয়। তারা বিভিন্ন ধাপে হিসাবটা দেয়। আবার শ্বেতপত্র বলেছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার। আবার সরকার যখন জিডিপি দেয়, তখন সেভেন পার্সেন্ট বা সিক্স পয়েন্ট ফাইভ পার্সেন্ট বলে। বিশ্বব্যাংক বলে ৬.১ শতাংশ, এডিবি বলে ৬.২ শতাংশ। এতটা বৈপরীত্য হয় না। কোথায় ১৭ বিলিয়ন আর কোথায় ২৩৪ বিলিয়ন? এটা থেকে বোঝা যায় যে শ্বেতপত্র নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। এই বিষয়গুলো তাদের চেক অ্যান্ড ব্যালান্স করে দেওয়া উচিত ছিল। এটা রূপকথা নয় যে শুনে শুনে দিয়ে দেওয়া যাবে।
প্রশ্ন : তাহলে কি শ্বেতপত্রও সরকারের মনোযোগে নেই?
উত্তর : পরিকল্পনা কমিশনও অর্থনীতির একটি টাস্কফোর্স করেছে। সেটার প্রধান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. কে এস মুর্শিদ। তিনি সম্প্রতি বলেছেন যে আমরা ৪০০ বা ৫০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট দিয়েছি। সরকারকে বলেছি, এগুলো এগুলো করতে হবে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, তাঁদের এত সময় নেই করার। এটা তো একটি তাবিজ না যে উনি ৪২০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টকে কোনোভাবে দিয়ে দেবেন; সেটা পড়ে তারা চট করে বুঝে যাবে। এ রকম তাবিজ তো অর্থনীতিবিদদের হাতে থাকে না। সংস্কার কমিশনের প্রধানের হতাশা প্রমাণ করে যে সংস্কার তো হয়নি। এটা দিয়ে প্রমাণ করে যে আমার আর নতুন করে কিছু দেওয়ার নেই। সত্যিকার অর্থে সরকারের অর্থনীতির দিকে কোনো মনোযোগ ছিল না বরং অন্যদিকে বিশেষ করে সামাজিক দিকে বিশৃঙ্খলাকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছে বা বাড়তে দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়েছেন।
প্রশ্ন : দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না কেন?
উত্তর : বিনিয়োগ তো এমনিতেই একটি স্থবিরতার মধ্যে ছিল। বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ। এটা যে রাতারাতি বাড়বে, সেটাও আমরা আশা করিনি। কিন্তু এখন যদি হিসাব নিয়ে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে তাদের অংশগ্রহণ কমে গেছে। বিনিয়োগের জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি সম্মেলন করা দরকার ছিল, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে নয়। কারণ বিদেশিরা এমনিতেই বাংলাদেশকে ভালো বলবে সৌজন্যের খাতিরে। আদর আপ্যায়ন পেলে এমনি ভালো বলে। কিন্তু ওরা বিনিয়োগ করে না। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের যদি ব্যবসা কমে যায়, তাদের যদি বিনিয়োগ কমে, তাহলে বিদেশিদের ডাকলেও হবে না। বার্তাটা হলো আগে ঘর ঠিক করতে হবে। মানে একটি স্থিতিশীলতা দরকার। ভিয়েতনাম সামরিক শাসিত হলেও সেখানে একটি স্থিতিশীলতা আছে। এ কারণে সেখানে বিনিয়োগ বেশি। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অস্বস্তি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসে না। অনেকটা পাত্র দেখার মতো। গ্রামে যখন কেউ পাত্র দেখতে আসে তখন খোঁজখবর নেয়। তারা বাড়ির পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা কেমন। ছেলের পরিবার বলল, ছেলেটা সোনা, সোনার ছেলে। তার মতো আর ছেলেই হয় না। আর দোকানে গিয়ে খবর পাওয়া গেল ছেলে বাকি খায়। আবার গাঁজাও খায়। তখন আমরা বুঝি যে এই ছেলের কাছে মেয়ে দেওয়া যাবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এ রকম বিষয় দেখে। কিছু কিছু কম্পানি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হয়তো বিনিয়োগ করেছে; কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। অর্থনীতির আকার যে রকম বড় হয়েছে, সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দরকার। মোটকথা হলো আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা যদি স্বস্তিতে না থাকে, তারা যদি নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকে, সে জায়গায় বিদেশি বিনিয়োগকারীও আসবে না। সুতরাং বিনিয়োগের ভালো পরিস্থিতি যদি সরকার তৈরি করতে না পারে তাহলে হবে না। এটা হচ্ছে ইন্ডিকেটর। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে যদি আমি চাঙ্গা করতে না পারি তাহলে জিডিপি কমতে থাকবে। এই যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে আছে, এটা হলো অতীব স্থবিরতার লক্ষণ। এই পরিস্থিতিটাকে মোকাবেলা করার জন্য এক নম্বর প্রায়োরিটিতে আনতে হবে। অর্থনীতির স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলাকে স্থিতিশীল রাখতে হয়। প্রতিটি স্থাপনা ভেঙে যাচ্ছে, দোকানপাট লুটপাট হচ্ছে, এগুলো ভালো বার্তা দেয় না।