চারদিকে শুধুই অবিশ্বাসের নিঃশ্বাস। তাই জানমালের নিরাপত্তায় বাড়ছে সচেতনতা। তবে সচেতনতার চর্চাটি গোপনে সৃষ্টি করছে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস আর সন্দেহপ্রবণতা। কিন্তু এতকিছুর পরেও মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে বিক্রেতা ছাড়াই গড়ে তোলা হয়েছে সততা স্টোর। বিক্রিও হচ্ছে সততার সঙ্গে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন— দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল
আমিনুল, অনিষা, সুপ্তি, নাজমিন, নাঈম এরা সবাই শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কেউ অষ্টম, কেউ নবম, কেউবা দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। লেখাপড়া শিখে কেউ হবে ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা ব্যারিস্টার। কে বলতে পারে, এদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে আগামী দিনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দেশের মন্ত্রী, এমপি। আজকের এই প্রজন্মই এক দিন এগিয়ে নিয়ে যাবে এ দেশকে। তাই আগামীর বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে এখন থেকেই সৎ মানুষ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পুঁথিগত শিক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গে শিশু বয়স থেকেই তাদের সততার অভ্যাস করানো হচ্ছে। দেশব্যাপী সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে দুদক। মানুষের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা থাকতে হলে শিশু বয়স থেকেই তাকে এভাবে গড়ে তুলতে হয়। তাই বর্তমান শিশুদের মনে ছাত্র অবস্থায় নীতি-নৈতিকতা এবং সততা গড়ে তুলতে দেশের প্রতিটি জেলার একটি উপজেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং একটি বালক বিদ্যালয়ে সততা স্টোর খুলে দেওয়া হচ্ছে। বিক্রেতাবিহীন এ সততা দোকানে শিশুরাই ক্রেতা, শিশুরাই বিক্রেতা। ফেব্রুয়ারিতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিটিআরআই উচ্চবিদ্যালয় ও সাতগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ে সততা স্টোর চালু করা হয়েছে।
সাতগাঁও উচ্চবিদ্যালয়েরই একটি কক্ষের নাম দেওয়া হয়েছে সততা স্টোর। সততা স্টোরে ঢোকার সময় ছাত্র-ছাত্রীরা টেবিলে রাখা রেজিস্টারে নিজের নাম, শ্রেণি ও রোল লিখে রাখছে। এ স্টোরে স্তরে স্তরে সাজানো হয়েছে খাতা, কলম, পেন্সিল, রাবার, স্কেল, জ্যামিতি বক্স, রং-পেন্সিল, চিপস, বিস্কুট। দেওয়া রয়েছে প্রতিটি পণ্যের মূল্য তালিকা। এ মূল্য তালিকা দেখে শিশুরা নিজেরাই নিজেদের পণ্য কিনে নিচ্ছে। টেবিলে রাখা তালাবদ্ধ ক্যাশ বাক্সে ফেলে দিচ্ছে পণ্যের মূল্য। তা ছাড়া পণ্যমূল্যের সঙ্গে যেসব পণ্য তারা ক্রয় করছে সাদা কাগজে সেসব পণ্যের নাম ও টাকার পরিমাণ লিখে ওই ক্যাশ বাক্সে ফেলে দিচ্ছে। একাধিক পণ্য হলে হিসাবের জন্য দেওয়া আছে ক্যালকুলেটর। এ ছাড়া সততা স্টোরে একটি প্রি-অর্ডার বই দেওয়া হয়েছে। যদি চাহিদামতো জিনিস পাওয়া না যায় তবে প্রি-অর্ডার বুকে অর্ডার দিতে হবে। ওই বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী সুপ্তি দত্ত জানায়, সততা স্টোরে কোনো মালিক নেই। আমরা নিজেরা চাহিদামতো জিনিস ক্রয় করে টাকা ক্যাশ বাক্সে রেখে দিচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা সততার পরিচয় দিচ্ছি। একই মন্তব্যের সঙ্গে নবম শ্রেণির নাঈম ইসলাম বলে, সততা স্টোর থেকে পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে আমরা সৎ মানুষ হয়েই বড় হবো।
দুদক সূত্রে জানা যায়, তরুণ প্রজন্মের মাঝে সততা, নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে একটি নীতিমালা জারি করেছে। ওই নীতিমালায় মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের প্রতিটি জেলার যে কোনো একটি উপজেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় এবং একটি বালক বিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে ‘সততা স্টোর’ স্থাপন, চালু ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পদ্ধতি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শক্রমে সততা স্টোরের প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করবে। ওই স্টোরে পণ্য হিসেবে থাকবে খাতা, কলম, পেন্সিল, রাবার, স্কেল, জ্যামিতি বক্স, রং পেন্সিল, চিপস, বিস্কুট ছাড়াও সততা সংঘের পরিচালনা কমিটির কাছে যেসব পণ্য ছাত্র-ছাত্রীদের আবশ্যক বলে প্রতীয়মান হবে সেগুলো। সততা সংঘের পরিচালনা কমিটি হবে— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ এবং সংশ্লিষ্ট মহানগর, জেলা, উপজেলার দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি-সম্পাদক কর্তৃক গঠিত কমিটি এ স্টোর পরিচালনা করবে। আর পণ্যের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি হবে বাজারমূল্যের সমান। সততা স্টোর মনিটরিংয়ের জন্য উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা ও মহানগরের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত কোনো কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট মহানগর, জেলা, উপজেলা দুর্নীতি দমন কমিটির সভাপতি-সম্পাদক বা তার মনোনীত প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সমন্বয়ে তিন সদস্যের কমিটি থাকবে। এ কমিটি প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈঠক করে হিসাব-নিকাশ যাচাই ও ক্রয়যোগ্য সামগ্রীর তালিকা প্রণয়নপূর্বক প্রয়োজনীয় অর্থ স্টোর পরিচালনা কমিটির কাছে প্রদান করবে।
সাতগাঁত্ত উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনুপ দত্ত বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। সৎ চর্চার মধ্য দিয়েই আগামী দিনের সৎ মানুষ গড়ে উঠবে। তিনি জানান, প্রতিদিনই তার বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সততা স্টোর থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছে এবং রক্ষিত বাক্সে রেখে যাচ্ছে মূল্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সিলেট বিভাগীয় পরিচালক শিরীন পারভীন এ প্রতিবেদককে বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সততার চর্চা করানোর জন্য, দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব তৈরি করার জন্য সততা স্টোর চালু করা হচ্ছে। যাতে তারা নিজেরা সৎ থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত সততা শিক্ষা দেওয়া হলে এ কাজের মাধ্যমে তাদের স্বচ্ছ মানসিকতা গড়ে উঠবে।
একই আঙ্গিকে সততা স্টোরের দেখা মিলবে আরও দুটি। দোকান আছে, পণ্য আছে, ক্রেতা আছে কিন্তু বিক্রেতা নেই। মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখেই দোকানটি চলছে। এটি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ভিন্ন রকম দোকান। পছন্দ হলে পণ্যের গায়ে মূল্য দেখে নির্দিষ্ট টাকার বাক্সে দাম পরিশোধ করেন সবাই। আশপাশে এমন দোকান না থাকলেও ক্রেতাদের আকর্ষণ যেন এখানেই বেশি। সৎ ও ভালো মনের ক্রেতারা এই দোকান থেকে পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহী। দোকানের মালিক হামিদুর রহমান শিপন বলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস ভালোবাসা পেয়েছি বলেই আমি এই দোকানটি গড়ে তুলেছি। আমি দেড় বছর ধরে দোকান চালাচ্ছি, এখনো চুরি হয়নি। মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি। যদি মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে এমন দোকান করা যায়, তবে দেশে চোর-ডাকাতও কম থাকবে।
দুনিয়াতে সবাই খারাপ নয়। ভালো মানুষও আছে। রাজবাড়ী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সততা স্টোর। নেই কোনো দোকানদার। এমনকি সিসি ক্যামেরাও নেই। বাচ্চারা প্রয়োজনমতো খাতা, কলম, চকলেট, পেন্সিল, খাবারসহ বিভিন্ন জিনিস নিজেরাই নিয়ে যেতে পারে। শুধু দামটা নির্দিষ্ট বাক্সে দিয়ে যেতে হয়। ‘যে অপরকে ফাঁকি দেয় সে নিজেকেই ফাঁকি দেয়’— এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম সততা স্টোরের মূল উদ্যোক্তা। শিশুদের সৎ, যোগ্য ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এই সততা স্টোরের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই শিক্ষাদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখছে। আজকের শিশুদের এই সৎ আচরণও সত্যিই এক মহৎ উদ্যোগ।