উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলার (মব সন্ত্রাস) বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিএনপি। সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় দলটি মব সন্ত্রাস ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান আরো স্পষ্ট করেছে। এই ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠিন বার্তা দিয়েছেন। দলের অন্য শীর্ষ নেতৃত্বও প্রকাশ্যেই নিন্দা জানিয়েছে এবং সাংগঠনিকভাবে এই ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
৫ আগস্টের পর থেকে যেসব মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে তাকে শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে বিএনপি। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান হচ্ছে জিরো টলার্যান্স নীতি। দলের কারো এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রবিবার ঢাকার উত্তরায় নুরুল হুদাকে তাঁর নিজের বাসা থেকে বের করে এনে হেনস্তা করা হয়।
এক পর্যায়ে তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাঁর মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করা হয়। এ সময় তাঁর গায়ে ডিম ছুড়ে মারা হয়। এর সঙ্গে বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ আছে। তবে বিএনপি এই ধরনের কর্মকাণ্ডের দায় নিতে রাজি নয়।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বিএনপির ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। কারণ গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রতিটি মব সন্ত্রাসের নিন্দা জানিয়েছি আমরা। এই কর্মকাণ্ড আমরা সমর্থন করি না। দলের কেউ জড়িত থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিএনপির কঠোর অবস্থান এসেছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যেও।
আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস উপলক্ষে গত বুধবার দেওয়া এক বাণীতে তারেক রহমান বলেছেন, ‘মব জাস্টিস নামে এক হিংস্র উন্মাদনা মানবতার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরিবেশ বিপন্ন করবে। আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সুষ্ঠু চর্চার কর্মপ্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি।’
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাব মতে, মব তৈরি করে মানুষের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে গত ৯ মাসে দেশে অন্তত ১৩১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ।
এর মধ্যে ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ধ্বংস, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে (৩২) পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। পরে পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২৯ এপ্রিল অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে পোশাক ছিঁড়ে পুলিশে সোপর্দ করে একদল লোক। এর আগে ৪ মার্চ রাজধানীতে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে একদল ব্যক্তি। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষকে জোর করে পদত্যাগ করানো, মানুষের বাসায় দল বেঁধে হেনস্তা ও মালপত্র নিয়ে যাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেওয়া, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হেনস্তাসহ নানা ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনার সঙ্গে বিএনপির জড়িত থাকার বড় ধরনের কোনো অভিযোগ সেভাবে আসেনি। তবে মাঠ পর্যায়ের কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ আছে। অবশ্য ৫ আগস্টের পর যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কঠোর হয়েছেন। নানা অভিযোগের প্রমাণ মেলায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ নানা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কড়া বার্তা বিএনপির
সম্প্রতি বিএনপির উচ্চ মহল থেকে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে তা দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জন্য বার্তা বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে বিভিন্ন পক্ষের প্রশ্রয়ে বিরোধীপক্ষকে হেনস্তা, বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তখনই বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছিল, এখন তা আবারও স্পষ্ট করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক কৌশলগত দিক থেকে বিএনপি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টি যখন সহিংসতাবিরোধী, তখন দলের ভাবমূর্তি বাড়াতে ‘মব সন্ত্রাস বিরোধী’ অবস্থানকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মী ও জনগণকে নতুন বার্তা দিয়েছে দলটি। বিএনপি তাদের ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দিয়ে বলেছে, কর্মসূচির আগে ও পরে নিজেদের দায়িত্বে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সহিংসতায় অংশ নেবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি বহিষ্কারও করা হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। বিএনপি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার তার দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরও মব সন্ত্রাস হয়েছিল। তখনো এর প্রতিকার করেনি তখনকার সরকার। ফলে দেশে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও মব সন্ত্রাস দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, ‘মব সংস্কৃতির শুরু করেছে কে? ইশরাকের প্রচারণায় বেগম খালেদা জিয়াকে মব সৃষ্টি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন মবের রানি শেখ হাসিনা। তিনিই মবের মাস্টারমাইন্ড।’ গত ২৫ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণতন্ত্র ফোরামের এক প্রতিবাদী যুব সমাবেশে মব নিয়ে জয়নুল আবদিন ফারুক এই মন্তব্য করেন।
তিনি আরো বলেন, ‘সাবেক সিইসি নুরুল হুদার ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবক দলের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিসি হারুনকে কেন গ্রেফতার করা হয় না। যারা ১৬ বছর ধরে অন্যায়-অত্যাচার করেছে, তাদের কেন গ্রেফতার করা হয় না?’
কঠোর অবস্থানে সেনাবাহিনীও
মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর সেনাবাহিনী। গত ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাপ্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা আক্রমণের বিরুদ্ধেও কঠোর বার্তা দেন।
ওই সময় তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী এখন আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না।
গত মার্চে রাজধানীর রাসেল স্কয়ারে মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে একজনের ব্যবসায়িক অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনার সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কলাবাগান থানার সমন্বয়ক পরিচয়ধারী সালাহউদ্দিন সালমানসহ ১৪ জনকে আটক করে কলাবাগান থানায় হস্তান্তর করে।
গত এপ্রিলে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতম গণহত্যার প্রতিবাদ বিক্ষোভের মিছিল থেকে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান দাবি করে কেএফসি, বাটাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। সে সময়ও সেনাবাহিনীকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়।
গত ২২ জুন সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদার ওপর মব ভায়েলেন্সের ঘটনা ঘটলে সেনাবাহিনী অভিযুক্তদের গ্রেফতারের জন্য দ্রুত অভিযান শুরু করে এবং ২৩ জুন হানিফ নামের এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশে হস্তান্তর করে। ওই ঘটনা ও সেনা অভিযান সম্পর্কে আইএসপিআর জানায়, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বিবৃতি দিয়ে দায় সারছে সরকার
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ঘটনার পর সরকারকে বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। নুরুল হুদার ঘটনার পরও বিবৃতি দিয়েছে সরকার। গত রবিবার রাতে সরকারের বিবৃতিতে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আক্রমণ ও তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা বেআইনি, আইনের শাসনের পরিপন্থী ও ফৌজদারি অপরাধ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘মব সৃষ্টি করে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী সকলকে চিহ্নিত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ তবে গত ১০ মাসে মব সন্ত্রাস দমনে সরকারের কার্যক্রম সেভাবে চোখে পড়ার মতো নয় বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।
সরকার অবশ্য বারবার মব সন্ত্রাস বন্ধ করার কথা বলছে। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাঁকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, ‘মব জাস্টিস’-এর কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। ওই ঘোষণা অনুযায়ী, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার তাঁকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে।
তবে অভিযুক্তের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি বলে সমালোচনায় পড়েছে সরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একদল ব্যক্তি মামলার আসামিকে ধরে হেনস্তা করছে, তারপর পুলিশে দিচ্ছে। কিন্তু সরকার এসব অপরাধ দমনে কঠোর হচ্ছে না।
আইনজীবীরা বলছেন, সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধিসহ অন্যান্য আইনের বিধান অনুযায়ী কাউকে আটক করার নামে হেনস্তা, জুতার মালা পরানো কিংবা শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা অপরাধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, মব বন্ধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, মব নিয়ে সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ জারি করছে। কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ না থাকায় মব উচ্ছৃঙ্খলতাকারীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।