‘চানখাঁরপুল মোড়ের উল্টাপাশে ছাপা পোশাকে অনেক পুলিশ ছিল। পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি। আমরা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আমাদের লক্ষ করে গুলি করে।’ এমনভাবেই গত বছর ৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকার ঘটনার বর্ণনা দেন প্রসিকিউশনের পঞ্চম সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তাঁর এ জবানবন্দিতে উঠে আসে পুলিশের গুলিতে নিহত ইয়াকুবের মৃত্যুর ঘটনাও।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শহীদ আহম্মেদ ছাড়াও নিহত ইয়াকুবের মা রহিমা আক্তার ও পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া ইসমামুল হকের ভাই মো. মহিবুল হক সাক্ষ্য দেন। পরে আসামি আরশাদ হোসেনের পক্ষে সাক্ষীদের জেরা করেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি। আসামি ইমাজ হোসেনের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী জিয়াউর রশিদ টিটো, আসামি সুজন হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী আবুল হোসেন। আর পলাতক আসামিদের পক্ষে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী কুতুবুদ্দিন। পরে এ মামলায় আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২০ আগস্ট দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, বি এম সুলতান মাহমুদ, তারেক আবদুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় এর আগে সোমবার একজন, মঙ্গলবার আরও দুজন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।
প্রসিকিউশনের পঞ্চম সাক্ষী ৪০ বছর বয়সি শহীদ আহম্মেদ পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। তিনি তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট আমি, আমার ভাতিজা ইয়াকুব, আমার ছেলে সালমান, এলাকার রাসেল, সুমন, সোহেলসহ আরও অনেকে সকাল আনুমানিক ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে গণভবনের উদ্দেশে রওনা দিই। আমরা চানখাঁরপুল এলাকায় পৌঁছালে দেখি সেখানে হাজার হাজার লোক চারদিক থেকে জড়ো হচ্ছিল। তখন দেখলাম চানখাঁরপুল মোড়ের উল্টাপাশে ছাপা পোশাকধারী অনেক পুলিশ। পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি। পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছিল।’
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রথমে আমাদের লক্ষ করে ফাঁকা গুলি করে। ওই সময় আমরা যে-যার মতো ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আবার যখন আমরা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করি তখন পুলিশ আমাদের লক্ষ করে গুলি করে। আমার পাশের একজনের পায়ে গুলি লাগে। তাঁকে আমি সরাচ্ছিলাম। তখন আমাকে একজন বলে-আপনার ভাতিজা ইয়াকুবের গায়ে গুলি লেগেছে। আমি ওই ছেলেকে আরেকজনের কাছে রেখে আমার ভাতিজার কাছে যাই। আরও দুজনসহ ভাতিজাকে অটোরিকশায় করে মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন-ইয়াকুব মারা গেছে। আমি আমার ছেলে সালমানকে ফোন করে ইয়াকুবের মাকে জানানোর জন্য বলি এবং তাকে হাসপাতালে আসতে বলি।’ জবানবন্দিতে আসামিদের নাম উল্লেখ করে বিচার চান এই সাক্ষী।
ছেলের শরীর থেকে তখনো অনেক রক্ত পড়ছিল : প্রসিকিউশনের চতুর্থ সাক্ষী ৫৪ বছর বয়সি রহিমা আক্তার তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার ছেলে মো. ইয়াকুব আন্দোলনে গিয়েছিল। সে নিউমার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান ছিল।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট চানখাঁরপুল নাজিমুদ্দিন রোডে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় ইয়াকুব। গুলি লাগার বিষয়ে শুনে আমি চিৎকার করে বাসা থেকে বের হয়ে গলিতে যাই। মহল্লার লোকজন আমাকে যেতে দেয়নি। আমাকে জানায়-আমার ছেলে সুস্থ আছে। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি শুরু করলে আমার সন্দেহ হয় আমার ছেলের কিছু হয়েছে।’
জবানবন্দিতে রহিমা বলেন, ‘বেলা আনুমানিক ২টার দিকে দেখি আমার ছেলের লাশ খাটিয়ায় করে গলির ভিতর নিয়ে আসে। শহীদসহ অনেকেই ছিল। ছেলের শরীর থেকে তখনো খাটিয়া বেয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল। আমি তার গায়ের কাপড় সরিয়ে দেখি পেটে গুলি লেগে পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে, রক্ত পড়া থামছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি পরবর্তীতে টিভি নিউজ, ভিডিও এবং বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি যারা গুলি করেছে তারা ছাপা কাপড়ের পোশাক পরিহিত ছিল। পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে পড়ে যায়। প্রতিবেশী শহীদ এ দৃশ্য তার মোবাইলে ধারণ করেছিল। যারা আমার ছেলের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল, যারা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের বিচার চাই।’
ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শুনে ঢাকা এসে লাশ নিয়ে ফিরি : প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী ২১ বছর বয়সি মো. মহিবুল হক। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘গত বছর ৫ আগস্ট আমার ভাই ইসমামুল হক (১৭) চানখাঁরপুলে গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা তখন চট্টগ্রামে ছিলাম। ইসমামুলের মোবাইল থেকে জনৈক ব্যক্তি আমাকে কল করে জানায়-আমার ভাই পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে ভর্তি আছে। ইসমামুল চকবাজার গফুর সওদাগরের দোকানে কাজ করত। আমি তাকে ফোন করলে তিনি হাসপাতালে গিয়ে ইসমামুলের খোঁজখবর নেন।’
মহিবুল জবানবন্দিতে বলেন, ‘যান চলাচল বন্ধ থাকায় আমরা সেদিন ঢাকায় আসতে পারিনি। পর দিন সকালবেলা আমি আমার আম্মা ও দুই আত্মীয়কে নিয়ে ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে জানতে পারি আমার ভাইকে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমরা গফুর সওদাগরকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার ভাইয়ের সাথে সামান্য কথাবার্তা হয়। সে সিসিইউতে ছিল। তার অবস্থার অবনতি হলে রাত ১০টার দিকে তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৭ তারিখ সকালে তার অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেদিন বিকাল ৪টার দিকে সে ইন্তেকাল করে। আমরা ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ইসমামুলের লাশ নিয়ে চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে যাই।’
মহিবুল তার জবানবন্দিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ মামলার আসামিদের নাম উল্লেখ করে ঘটনার জন্য তাদের দায়ী করেন। চান দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, মোস্তাকিম, ইয়াকুব, ইসমামুলসহ কয়েকজন নিহত হন। এ ঘটনায় মামলার পর ছয় মাস ১৩ দিনে তদন্ত শেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটি। এটিই ছিল জুলাই-আগস্টের গণ আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন। পরে ২৫ মে এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। এ মামলায় ৭৯ জনকে সাক্ষী করেছে প্রসিকিউশন। পরে ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সে ধারাবাহিকতায় গত সোমবার প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের পর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।