পেশা রাজনীতি। রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন সন্ত্রাসী ক্যাডার। কিন্তু গত ১৫ বছরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তমা-ম্যাক্সের দালালি করে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশে-বিদেশে পাওয়া যাচ্ছে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিপুল সম্পদের সন্ধান। বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই আজম দম্পতির হাজার কোটি টাকার সম্পদ আওয়ামী শাসনামলে ভয়াবহ দুর্নীতি ও লুণ্ঠনেরই প্রমাণ।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন মির্জা আজম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে। তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে চালাচ্ছে অনুসন্ধান। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পৃথক আবেদনে জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজম ও তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার নামে জামালপুরের ১৯ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তাদের ৩১টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে, এসব হিসাবে ৩ কোটি ৮০ লাখ ২৩ হাজার ৯৫৮ টাকা রয়েছে। গত ২৪ মার্চ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন। মির্জা আজমের বিষয়ে আবেদনে বলা হয়, মির্জা আজম সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে নিজ নামে-বেনামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ হাজান ২০০ টাকা এবং তার মেয়ে আফিয়া আজম অপির নামে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেন। এসব সম্পদ নিজের দখলে রেখে, পরিবারের সদস্যসহ অন্যদের নামে ২০ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি হেবা বা দান বা বিনিময়ের মাধ্যমে হস্তান্তর ও রূপান্তর করেন। নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তার স্ত্রী আসামি দেওয়ান আলেয়াসহ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার ২৩২ টাকা জমা ও ৭২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৫ টাকা উত্তোলনপূর্বক অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে জ্ঞাতসারে তার অপরাধলব্ধ অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করে অপরাধ করায় তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা দায়ের করে। মির্জা আজম কর্তৃক অর্জিত সব সম্পদ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তদন্তকালে প্রাপ্ত তার নিজ নামীয় ও তার কন্যা মির্জা আফিয়া আজমের নামীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ (ব্যাংক হিসাব) যেন তিনি অন্যত্র হস্তান্তর ও স্থানান্তর করতে না পারেন সেজন্য তার এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ (ব্যাংক হিসাব) অবরুদ্ধ করার আবেদন করেছিল দুদক, যা আদালত মঞ্জুর করেন। আলেয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আবেদনে বলা হয়, আলেয়া তার স্বামী মির্জা আজমের প্রভাব খাটিয়ে এবং তার সহযোগিতায় নিজ নামে-বেনামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজান ৯৯৫ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেন। তা নিজের দখলে রেখে এবং তার নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১৮১ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা জমা ও ১৭৯ কোটি ২৬ লাখ ৯৬ হাজার ৪৯ টাকা উত্তোলনপূর্বক অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে জ্ঞাতসারে তার অপরাধলব্ধ অবৈধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর করেছেন এ জন্য দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
মির্জা আজমের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, মির্জা আজম ও তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার ব্যাংক হিসাবে ৯০৮ কোটি টাকার লেনদেনের সন্ধান পেয়েছে দুদক। মির্জা আজম দম্পতির ৮০টি ব্যাংক হিসাবে ৯০৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকার এ অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেছে সংস্থাটি। দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান বাদী হয়ে এ-সংক্রান্ত দুটি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারা ও ৪ (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, মির্জা আজমের নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালিত ২৪টি ব্যাংক হিসাবে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৩৯০ কোটি ৮১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭৯ টাকা জমা হওয়ার সন্দেহভাজন তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৫৭ হাজার ৪৬৬ টাকা তুলে ফেলেছেন। সর্বশেষ স্থিতি ছিল ১ কোটি ১০ লাখ ১১ হাজার ৯১৩ টাকা। যা ফ্রিজ অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে মির্জা আজম তার নিজ নামে ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৩টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ঋণ উত্তোলন করেছেন। ১৩টি ব্যাংক হিসাবে গত অক্টোবর পর্যন্ত তিনি ২৯৯ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪৮৫ টাকা উত্তোলন করেছেন এবং ৩০০ কোটি ৩৭ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৪ টাকা জমা দিয়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে। এ ছাড়া মির্জা আজম ও তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ২৩টি হিসাবের বিপরীতে এফডিআর ৭০ কোটি ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৫ টাকা পাওয়া গেছে।
মির্জা আজম ও দেওয়ান আলেয়াসহ তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির নামীয় মোট ৬০টি ব্যাংক হিসাবে ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার ২৩২ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। যার মধ্যে ৭২৪ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৭১৬ টাকা উত্তোলন করার প্রমাণ মিলেছে। অন্যদিকে মির্জা আজমের প্রভাব খাটিয়ে নিজ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের ২০টি হিসাবে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৮১ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে মির্জা আজম ও দেওয়ান আলেয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন নামে মোট ৮০টি ব্যাংক হিসাবে ৯০৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪ হাজার ২৩২ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর ওই লেনদেন অস্বাভাবিক বলে দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করেছে।
মামলায় সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের বিরুদ্ধে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা, তাদের মেয়ে মির্জা অপির নামে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা এবং তার স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার বিরুদ্ধে ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। জামালপুরের পৌর এলাকায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের স্ত্রী আলেয়া আজমের নামে গড়ে তোলা হয়েছে বিলাস বহুল আলেয়া গার্ডেন নামের একটি রিসোর্ট। যাকে রংমহল হিসেবেই আখ্যায়িত করেছে স্থানীয়রা। ক্ষমতা হারানোর পর এই রিসোর্ট নিয়ে বেরিয়ে আসছে নানা রোমহর্ষক কাহিনি।
জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসন থেকে সাতবারের এই সংসদ সদস্যের (এমপি) দাপট ছিল জেলাজুড়ে। অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা সেই এমপির স্ত্রীর নামে প্রায় ছয় একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে আলেয়া গার্ডেন। এই গার্ডেনে ছিল গরু ও মুরগির খামার, পুকুর, বিলাসবহুল ভবন। এ ছাড়া গার্ডেনটিতে করা হয়েছিল ফল এবং ফুলের বাগান।
এলাকাবাসীর অভিযোগ মির্জা আজম ক্ষমতায় থাকাকালে তার স্ত্রী আলেয়া আজমের নামেই গড়ে তোলেন এই রিসোর্ট। তার বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা সোরহাব হোসেন বাবুলের মাধ্যমে এই গার্ডেনের জমি জোরপূর্বক দখল করেছেন। অনেকেই জমির টাকা পেতে মির্জা আজম এবং আলেয়া আজমের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেই করা হতো নির্যাতন।
দেউরপাড় চন্দ্রা এলাকার আওয়ামী লীগের সাবেক ওয়ার্ড সভাপতি মন্জুরুল হক ফজলু বলেন, ‘এরা আমার পদ খেয়েছে। দীর্ঘদিন আমি এই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। মির্জা আজম, সোরহাব হোসেন বাবুল আমাকে সভাপতির পদ থেকে বাদ দিয়েছেন। আমার জমি দখল করে এই আলেয়া গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছে। মোট ২৬ শতাংশ জমির মধ্যে ১৩ শতাংশের দাম দিয়ে বাকি ১৩ শতাংশ দখল করে দেয়াল নির্মাণ করেছে। রাতের বেলা এখানে কী হতো জানি না। এলাকার কোনো মানুষকে এর আশপাশে আসতে দেওয়া হতো না।’
দেউড়পাড় চন্দ্রা এলাকার রেজিয়া বেগম বলেন, আমার স্বামী নাই। ঘর নাই, বাড়ি নাই। যেটুকু সম্বল ছিল মির্জা আজম আমার সব কেড়ে নিয়েছে। কত ঘুরেছি। মির্জা আজমের বন্ধু সোরহাব হোসেন বাবুলের কাছে গেছি। কেউ জমির টাকা দেয়নি। মির্জা আজম তার বউ আলেয়া আজম জামালপুরে এলে খবর পেয়ে গেছি কিন্তু গেলেই গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দিতেন। আমার জমিটা আমি ফেরত চাই।
দখলদারি নিয়ে জামালপুর সচেতন নাগরিক কমিটি সনাকের সভাপতি শামিমা খান বলেন, দখলবাজ যেই হোক, অপরাধী অপরাধীই। সে দলের হোক যার আত্মীয়ই হোক তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।
বর্তমানে এই রিসোর্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন হাসান নামের এক ব্যক্তি। তিনিও স্বীকার করেছেন জমি দখলের কথা। তার পরিবারের জায়গা জমি নিয়েছেন চাকরি দেওয়ার নাম করে। কিন্তু কাউকেই চাকরি দেননি মির্জা আজম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর পরই এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতা আলেয়া গার্ডেনে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এভাবেই তমা ও ম্যাক্সের ঠিকাদারি তদারকি করে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন মির্জা আজম।