অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলেছেন, তাঁর সরকারের ওপর প্রধানত তিনটি কাজের দায়িত্ব ছিল। সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভেঙে পড়া সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, স্বৈরাচার ও তার দোসরদের বিচার এবং একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। গত ৫ আগস্ট রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি তা করেছেনও। পর দিনই নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেছেন। তাঁর এ উদ্যোগে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তাঁর নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু মাত্র এক মাস ছয় দিনের মাথায় তাঁর আদরের বিপ্লবীরা স্পষ্ট করে ঘোষণা দিলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। বিপ্লবীদের এ ঘোষণায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। প্রশ্ন হচ্ছে-তাহলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন কী করবেন? শ্যাম রাখবেন নাকি কুল রাখবেন। তাহলে কি আমার প্রিয় পাঠক মাহতাব উদ্দিনের আশঙ্কাই সত্যি হতে যাচ্ছে? নাকি নির্বাচনবিরোধী বিপ্লবীরা প্রতিবিপ্লবের মুখোমুখি হবেন।
৫ আগস্ট ২০২৪-এর আগে-পরে কৌলীন্য প্রকাশের ভঙ্গিতে বেশ কিছু শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অন্যতম হলো ‘নতুন বন্দোবস্ত’ ও ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। আমরা যদি আমাদের রাষ্ট্র গঠন ও স্বাধীনতার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবচেয়ে স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বন্দোবস্ত করার জন্যই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ার প্রয়োজন হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকরা এ প্রয়োজন অনুভব করেননি। সেই সঙ্গে আমাদের দেশের কিছু মানুষও পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন বোধ করেনি। সে কারণেই তাদের অবস্থান ছিল মুুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে তারা যোগ দেয় পাকিস্তানিদের পক্ষে। যারা সেদিন বাংলাদেশটা চায়নি, ৫৪ বছর পর নতুন বন্দোবস্তের নামে তারাই এখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলছে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যারা মানতে পারেনি, তারাই এখন দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথা বলে ’৭১-কে অস্বীকারের অপচেষ্টা করছে। ’৭১ সালে তাদের চেহারা সবার কাছে পরিচিত ছিল। কিন্তু সেই পরিচিত চেহারার আড়ালে এখন অনেক নতুন চেহারা ভেসে উঠছে। নেহরু ডকট্রিনের ধুয়া তুলে নতুন নতুন তাত্ত্বিকও ’৭১ অস্বীকারের স্পর্ধা দেখাচ্ছে। অর্থাৎ যারা মুক্তিযুদ্ধ মানতে পারেনি, ’৭১-এর স্বাধীনতা মানতে পারেনি, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা মানতে পারেনি তারা ও তাদের নতুন প্রজন্ম ‘নতুন বন্দোবস্ত’ ও ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বর্তমান রাজনীতিতে তারাই বিএনপির প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় দল হিসেবে বিএনপির অবদান ছিল না। কারণ সে সময় বিএনপির জন্ম হয়নি। তবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ইচ্ছা করলেও লেখা সম্ভব নয়। মেজর জিয়া ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। তিনি শুধু যুদ্ধই করেননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি। শিশুর জন্মের পর প্রথম কান্নার মতো। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন; বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেই দলের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ’৭১-এর স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার একমাত্র কান্ডারি এখন শহীদ জিয়ার দল বিএনপি। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয়তাবাদী শক্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা তারেক রহমানই বুঝতে পারছেন নির্বাচন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে কী ভয়ংকর ষড়যন্ত্র চলছে। এ তিনজনই উপলব্ধি করতে পারছেন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সে কারণেই লন্ডন বৈঠকে একমত হয়েছেন ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না বলে যারা ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সবাই ড. ইউনূসের প্রিয়ভাজন। সর্বমহলে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য, অগ্রজের একটি সিদ্ধান্ত যদি তাঁরই আদর্শের অনুজরা মানতে অস্বীকার করেন, তাহলে এর নেপথ্য কারণ কী থাকতে পারে, তা খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা যদি দেশ ও গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হয়, তাহলে অতীতের মতো জনগণই তা প্রতিহত করবে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর আর কোনো প্রতিবিপ্লব হবে না। যারা নির্বাচন প্রতিহত করতে চায় তাদের হয়তো এবার প্রতিবিপ্লবের মুখোমুখি হতে হবে।
চন্দন গাছের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনের অনেক সাদৃশ্য আছে। বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করলে চোখে পানি চলে আসে। আমরা এখন একটি অনুর্বর ধূসর সময় পার করছি। পুরাতন ভেঙে নতুন গড়ার খেলা সবাই খেলছি ঠিকই, কিন্তু কোনটা পুরাতন, কোনটা নতুন তা বুঝতে বুঝতেই সময় পার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অস্থিরতা আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন নানাভাবে স্পর্শ করছে। যত দিন যাচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ আমাদের গ্রাস করছে। আদর্শহীন বর্তমান আমাদের অক্টোপাসের মতো গিলে খাচ্ছে। সন্তান পিতা-মাতাকে আইডল মনে করতে পারছে না। আলোকিত মানুষের অভাব সব ক্ষেত্রে অনুভূত হচ্ছে। নীতিহীন রাজনীতিতে চন্দনের মতো সুবাসিত নেতার সংকটও দিনদিন তীব্র হচ্ছে। এমন একটা কঠিন সময়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ষড়যন্ত্র নতুন সংকট তৈরি করবে।
চন্দন গাছ আমাদের জীবন কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা দুই বন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। দুই বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একজন ইতিহাসের, অন্যজন বোটানির। একদিন ইতিহাসের বন্ধু বোটানির বন্ধুকে বলল, ‘আমি চন্দন গাছ চিনি না। আমাকে চন্দন গাছ দেখাও।’ তারপর দুই বন্ধু মিলে একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেল। একটি শ্বেতচন্দন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বোটানির বন্ধু বলল, ‘এই হলো চন্দন গাছ, এটা হলো শ্বেতচন্দন। তবে আরেক রকম চন্দন আছে, সেটা হলো রক্তচন্দন বা লাল চন্দন। লাল চন্দনের গাছ খুব কম দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে শ্বেতচন্দন গাছ অনেক স্থানেই আছে। ইদানীং এটি বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করা হয়। চন্দন অতি মূলবান গাছ।’ ইতিহাসের বন্ধু চন্দন গাছ স্পর্শ করল, গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল। গাছের কাণ্ডে নাক লাগিয়ে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু না, কোনো গন্ধ পেল না। অবশেষে হতাশ হয়ে সে বলল, ‘না, আমি হতাশ হলাম। আমি তো ভেবেছিলাম চন্দন গাছের পাতা, কাণ্ড থেকে সুঘ্রাণ পাওয়া যাবে। সেজন্যই তো এত আগ্রহ নিয়ে এলাম।’ হতাশ বন্ধুকে সান্ত্বনা দিয়ে বোটানির বন্ধু বলল, ‘শোনো, চন্দনের সঙ্গে আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, যা শুনলে তোমার চোখে পানি চলে আসবে। চন্দন গাছ যখন জীবিত থাকে তখন আমাদের ছায়া দেয়। চন্দন গাছের ছায়া খুব শীতল। আর এ গাছ যখন কাঠ হয় অর্থাৎ যখন কাটা হয়, যখন এ জীবিত গাছ মরে কাঠ হয়ে যায় তখন সুবাস ছড়ায়। এ ছাড়া চন্দন যে কত কাজে লাগে বলে শেষ করা যাবে না। ঠিক আমাদের পিতা-মাতা, অভিভাবকদের মতো। আমাদের পিতা-মাতা, অভিভাবকরা যখন জীবিত থাকেন তখন আমাদের ছায়া দিয়ে রাখেন। তাঁদের ছায়ায় আমরা নিরাপত্তার নিশ্চিত শীতলতায় থাকি। আর যখন তাঁরা মারা যান তখন তাঁদের সুখ্যাতি, পরিচয়, মায়া-ভালোবাসার সুবাসে আমরা বেঁচে থাকি। তাঁরা হন আমাদের জীবনপথের পাথেয়। সে কারণে যাদের পিতা-মাতা জীবিত আছেন তাদের উচিত পিতা-মাতার সেবাযত্ন করা। পিতা-মাতার ছায়া আরও বেশি গ্রহণ করা। আর যাদের পিতা-মাতা বেঁচে নেই তাদের উচিত পিতা-মাতার আদর্শ ধারণ করে পথচলা। একইভাবে পিতা-মাতা বা অভিভাবকের আদর্শও হওয়া উচিত চন্দনের মতো সুবাসিত। তাঁরা না থাকলেও তাঁদের সুবাস যেন থাকে। চন্দন অত্যন্ত দামি গাছ ও কাঠ। আমাদের যাঁরা পিতা-মাতা, অভিভাবক তাঁরা এমন দামি যে কোনো কিছুর বিনিময়েই তাঁদের মূল্য দেওয়া সম্ভব নয়। তুল্য নন তাঁরা কোনো কিছুরই সঙ্গে।’ বোটানির বন্ধুর কথা শুনে নিজের অজান্তেই চোখ থেকে পানি পড়ছিল ইতিহাসের বন্ধুর। মাত্র দুই মাস আগে সে তার পিতাকে হারিয়েছে। পিতার কথা মনে করে সে চন্দন গাছ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল। সঙ্গী বোটানির বন্ধুও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। কারণ সে যখন ছোট তখন তার পিতার মৃত্যু হয়। আর গত বছর সে তার মাকে হারিয়েছে। দুই বন্ধুই তাদের প্রিয় চন্দন গাছটি হারিয়েছে। তারা এখন তাদের হারানো চন্দনের সুবাস নিয়েই চলছে।
আমাদের চলতি অস্থির ও বন্ধ্যা সময়ে দুজন মানুষই চন্দনের চেয়ে বেশি দামি। জাতির ক্রান্তিকালে এ দুজনই আমাদের একমাত্র ভরসা। একজন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্যজন বেগম খালেদা জিয়া। গত ২২ জুন পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী আওয়ামী লীগসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫১ এবং নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ১৪৩টি দল। এ বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক দলের মধ্যে কজন নেতা চন্দনের মতো দামি হতে পারছেন বা পারবেন বলা মুশকিল। তবে তথাকথিত নেতা হওয়ার চেষ্টা করছেন সব দলের কর্মকর্তাই। চন্দন হতে হলে ত্যাগ করতে শিখতে হয়। দেশ ও জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। আর বর্তমান সময়ে ত্যাগ নয়, ভোগেই শান্তি খোঁজেন অধিকাংশ নেতা। জাতীয়তাবাদের একমাত্র কান্ডারি বেগম খালেদা জিয়া সারা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করেছেন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ছিলেন অতন্ত্র প্রহরী। জাতির এ চরম দুঃসময়ে কান্ডারি হয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমাদের এ মহামূল্যবান দুই চন্দন বৃক্ষই পারেন ক্রান্তিকাল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে। যত বাধাই আসুক, প্রতিশ্রুত সময়ে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের যাত্রাটা যদি শুরু করা যায়, তা হলেই আমাদের শেষরক্ষা হবে। চন্দনের শীতল ছায়ায় আমরা আগামীর পথ চলতে পারব।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন