‘ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’। এ প্রকল্পটি একনেকে পাস হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের মার্চে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে সড়ক বিভাগ। এ ধরনের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয় একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে। যে কমিটির চেয়ারম্যান থাকেন সচিব। কিন্তু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাদ সাধলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেবেন তিনিই। সাতজনের সংক্ষিপ্ত তালিকা এবং জীবন বৃত্তান্ত দেওয়া হলো তার (ওবায়দুল কাদের) টেবিলে। দুই দিনের মধ্যেই ঠিকাদাররা যোগাযোগ শুরু করলেন তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে। ডিপিপিতে এ প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৭৫৭ কোটি টাকা। পরে তিন ধাপে বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারিত হয় ১৩৭৫ কোটি টাকা। সাতজনের মধ্যে একজন প্রকল্প পরিচালক হওয়ার জন্য ১০ কোটি টাকা দিতে রাজি হন। একজন ঠিকাদার এই অর্থ পরিশোধ করেন। শর্ত হলো, প্রকল্পের কাজ তাকে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ‘প্রকল্প পরিচালক’ হিসেবে নিয়োগ পান ওই সর্বোচ্চ ঘুষ দিতে সম্মত হওয়া ব্যক্তি। ওবায়দুল কাদেরের রাজত্বে সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগে এভাবেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হতো। সাড়ে ১২ বছরের বেশি সময় ওবায়দুল কাদের সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। যেহেতু তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কাজেই এ দুই মন্ত্রণালয়ের তিনি ছিলেন সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। তাকে কোনো মন্ত্রী বা আমলা প্রশ্ন করতে পারতেন না। আর এ সময় অদ্ভুত দুর্নীতির নেশায় আসক্ত হয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। ওবায়দুল কাদেরের দুর্নীতি কেবল কমিশনবাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কমিশনবাণিজ্যের পাশাপাশি ওবায়দুল কাদের তার মন্ত্রণালয়ের নিয়োগের ক্ষেত্রেও মহাদুর্নীতি করেছেন। গত সাড়ে ১২ বছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের মোট প্রকল্প হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৬৬৭টি। এ সময় সেতু বিভাগে প্রকল্প হয়েছে ৫৭২টি। এসব প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের দেওয়া হতো অফুরন্ত ক্ষমতা। প্রকল্প পরিচালকরাই ডিপিপি তৈরি করতেন। সেই ডিপিপি পাস করানো হতো। কোন বিষয়ে ডিপিপি তৈরি করা হবে সেটি বলে দিতেন ওবায়দুল কাদের। এসব প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে হতো ওবায়দুল কাদেরের অনুমতি নিয়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে ওবায়দুল কাদের অগ্রিম টাকা নিতেন। ধরা যাক, একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হলো ১০০ কোটি টাকা। প্রথমেই ডিপিপি তৈরির ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হতো। এরপর প্রকল্প পরিচালকের জন্য সড়ক ও জনপদ বিভাগ অভ্যন্তরীণভাবে প্রকল্প পরিচালক বাছাই প্রক্রিয়ার আয়োজন করত। সেই নির্বাচন কমিটির প্রধান ছিলেন ওবায়দুল কাদের। যারা প্রকল্প পরিচালক হতে আগ্রহী তাদের মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫ শতাংশ আগেই জমা দিতে হতো। অগ্রিম ৫ শতাংশ টাকা জমা না দিলে তিনি প্রকল্পপ্রধান হতে পারতেন না। ফলে প্রকল্পপ্রধানের স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগে। নিয়ম করে দেওয়া হয়েছিল যে, প্রকল্পপ্রধানের যারা সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হবেন, তাদের সবাইকে ওবায়দুল কাদেরের সিন্ডিকেটের যে সদস্য আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
ওবায়দুল কাদেরের দুর্নীতির জন্য একটি সিন্ডিকেট ছিল। এ সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের, ভাই আবদুল কাদের মির্জা, ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, নোয়াখালীর সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী। প্রকল্প পরিচালক হতে ইচ্ছুকরা জানতেন যে, কাকে ধরলে তার প্রকল্পপ্রধান হওয়া যাবে। প্রকল্প পরিচালক হতে ইচ্ছুক প্রত্যেকেই কেউ হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে, কেউবা তার ভাইয়ের সঙ্গে, কেউবা নিজাম হাজারীর সঙ্গে অথবা কেউ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন এবং সেভাবেই টাকা-পয়সার লেনদেনের ফয়সালা হতো। ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত হতেন যে, তার কাঙ্ক্ষিত অর্থ তিনি পেয়েছেন। এ অর্থ পাওয়ার পর পরই তিনি প্রকল্পের কাজ শুরুর অনুমতি দেন। এরকম একাধিক প্রকল্প পরিচালক এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। উল্লেখ্য, বিআরটিএর ১৩৭টি বাস কেনার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। এ প্রকল্প পরিচালককে ১০ কোটি টাকা দেওয়ার শর্তে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ১ কোটি টাকা দেওয়ার পর প্রকল্পের পরিচালক পদে এসে তিনি বাকি টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। এরপর ওবায়দুল কাদের তার ওপর রুষ্ট হন। এ প্রকল্পই পরবর্তীতে বাতিল করে দেন। এরকম অনেক প্রকল্প পাওয়া গেছে, যেখানে প্রকল্প তৈরি হওয়ার পরও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থমূল্য ওবায়দুল কাদের নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, সেই অর্থ মূল্য দিতে অনেকে অস্বীকৃতি জানান। মজার ব্যাপার হলো যে, প্রকল্প পরিচালকদের মধ্যেও একটা সিন্ডিকেট হয়েছিল। হাতেগোনা কিছু কর্মকর্তাকে বড় বড় প্রকল্পগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া হতো। এরকমও ব্যক্তি আছেন, যিনি একাই আটটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যিনি বড় বড় একটি বা দুটি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকেন তার পক্ষে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সহজ হয়। ওই টাকা দিয়ে তিনি আরেকটি প্রকল্প নেন। এর মধ্য দিয়ে ঠিকাদারদেরও একটা সিন্ডিকেট হয়েছিল। যে সিন্ডিকেটগুলো তাদের পছন্দের প্রকল্প পরিচালকের জন্য বিনিয়োগ করতেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সওজের মোট কাজের ৯০ শতাংশ করেছে ১২ থেকে ১৫টি ঠিকাদার। অর্থাৎ বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, ঠিকাদাররা যাকে পছন্দ তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করতে পারতেন। ওই প্রকল্প পরিচালককে ঠিকাদাররাই নিয়ে যেতেন ওবায়দুল কাদের সিন্ডিকেটের কাছে। ওবায়দুল কাদেরের সিন্ডিকেটের কাছে গিয়ে যে টাকা লেনদেনের ব্যাপারে ফয়সালা হতো। টাকা ঠিকাদাররাই দিতেন। শর্ত হলো তাকে ওই প্রকল্পের কাজ দিতে হবে। এভাবেই একটা দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়েছিল সড়ক ও জনপদ বিভাগে। ফলে দেখা গেছে, একদিকে যেমন সড়ক ও জনপদে কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হয়েছে। খরচ হয়েছে অত্যন্ত বেশি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়নি। সিন্ডিকেট লুণ্ঠনের একটি মডেল তৈরি করেছিলেন ওবায়দুল কাদের তার মন্ত্রণালয়ে। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক এরকম একটি প্রকল্প, যেখানে প্রকল্পপ্রধানের নিয়োগ মূল্য তিন দফা বৃদ্ধি করা হয়। এ বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয় প্রায় ১২ গুণ। এভাবে দুর্নীতির ব্যাপ্তি ছিল সর্বত্র। ওবায়দুল কাদেরের প্রিয় শখ ছিল যে, তিনি বিভিন্ন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখতেন। সেই প্রকল্প এলাকা দেখার সময় প্রকল্প পরিচালকদের এবং ঠিকাদারদের বাড়তি খরচ বহন করতে হতো। এসব বাড়তি খরচের মধ্যে ছিল যেসব সাংবাদিক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাবেন তাদের প্রত্যেককে বিকাশে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হবে। ওবাদুল কাদেরের যে বহর যাবে সেই বহরের সবাইকে আপ্যায়ন করাতে হবে। ওবায়দুল কাদেরের জন্য আলাদা বিশেষ উপঢৌকন দিতে হবে। প্রতিটি ধাপে এসব সুষ্ঠুভাবে করার পর একজনের বিল অনুমোদন চূড়ান্ত হতো। তবে যারা ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটের সদস্য তাদের ক্ষেত্রে এসবের বালাই ছিল না। তারা এককালীন মাসোহার দিতেন। হিসাব করে দেখা গেছে, সওজের একটি প্রকল্পের ৫০ শতাংশই ব্যয় হতো দুর্নীতির জন্য। বাকি ৫০ শতাংশ দিয়ে কাজ হতো। এতে কোনো অসুবিধা হতো না। জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা লুট হতো মাত্র! কারণ একটি ৫০ কোটি টাকার সড়ক নির্মাণের জন্য সবসময় ব্যয় ধরা হতো ১০০ কোটি টাকা বা ১১০ কোটি টাকা। ফলে ৫০ কোটি টাকা ঘুষে চলে গেলেও একজন ঠিকাদার লাভ করতেন। এজন্যই এখানে ঠিকাদাররা কাজ করার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের এই ১২ বছরের রাজত্বে মন্ত্রণালয়ের সচিব, কর্মকর্তা, প্রকৌশলীদের কোনো কদর ছিল না। ওবায়দুল কাদের ঠিকাদার এবং প্রকল্প পরিচালক- এই ত্রয়ী মিলে দুর্নীতি এবং লুটপাট করতেন। সচিব, আমলাদের কাজ ছিল ওবায়দুল কাদের যেভাবে বলবেন সেভাবে ফাইল উঠিয়ে দেওয়া এবং ফাইলে স্বাক্ষর করা।