বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু ও দুটো হলদে পাখি

ইমদাদুল হক মিলন

বঙ্গবন্ধু ও দুটো হলদে পাখি

বঙ্গবন্ধু যখন জেলখানায় থাকতেন তখন জেলগেটে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কিছু খাতা পৌঁছে দিতেন। বঙ্গবন্ধুকে বলতেন, জেলখানায় বসে বসে তোমার জীবনের কথা লিখ। বঙ্গবন্ধু তা-ই করতেন। জেল থেকে বেরিয়ে খাতাগুলো দিতেন জীবনসঙ্গিনীর হাতে। বেগম মুজিব অতিযত্নে খাতাগুলো শোবার ঘরের আলমারির ওপর এক কোণে রেখে দিতেন। ’৭১ সালে পাকিস্তানিরা এ বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে নিয়ে যায়। বাড়ি তছনছ করে। বঙ্গমাতা সন্তানদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন।

’৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আবার তছনছ এবং ধ্বংস হয় বাড়ির আসবাবপত্র। কিন্তু বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য দু- দুবার ৩২ নম্বরের বাড়ির ওপর দিয়ে এই ঝড়ঝঞ্ঝা ও নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে যাবার পরও শোবার ঘরের আলমারির ওপরের কোণায় রাখা খাতাগুলো অক্ষত ছিল। সেসব খাতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাজীবনের কথা লিখেছেন, চীন ভ্রমণের কথা লিখে রেখেছেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বসে যে খাতাগুলোয় নিজের আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন সেই খাতাগুলো ওখানে ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শোবার ঘরের আলমারির ওপর রাখা খাতাগুলো পেয়ে, বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা দেখে অঝোরধারায় কাঁদলেন। এসব খাতা থেকে শুরু হলো পা-ুলিপি তৈরির কাজ। দুটো বইয়ের প্রস্তুতি চলল। ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’।

এ সময় তাদের এক ফুফাতো ভাই আরও চারটা খাতা এনে বঙ্গবন্ধুকন্যাদের হাতে দিলেন। সঙ্গে কিছু টাইপ করা কাগজ। এই তো বঙ্গবন্ধুর সেই শেষ না হওয়া আত্মজীবনীর খাতাগুলো! দুই বোন আবার চোখের জলে ভাসলেন। শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর প্রথম বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পান্ডুলিপি তৈরির কাজ। কী যে কষ্ট করতে হলো এই বই নিয়ে! পোকায় খেয়ে ফেলেছে অনেক কাগজ। কোথাও কোথাও লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। দিনের পর দিন দুই বোন তাঁদের খুব কাছের আরও কয়েকজন মানুষকে নিয়ে বইটির কাজ করতে লাগলেন। তারপর প্রকাশিত হলো এক অবিস্মরণীয় ও অসামান্য গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।

বইটির ভূমিকায় এই ইতিহাস অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও চমৎকার ভঙ্গিতে লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

সেই শৈশব থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সাল অবধি নিজের জীবন, বড় হয়ে ওঠা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান, দেশভাগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ গঠন, ভাষা আন্দোলন এত আকর্ষণীয় এবং সরল সহজ ভঙ্গিতে লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু, ভাবলে বিস্ময় জাগে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর এই বই পড়ে সুধীমহল এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সব রাজনৈতিক নেতার আত্মজীবনীমূলক রচনার সীমা ছাড়িয়ে অনেক উচ্চতায় উঠে গেছে। ইংরেজিসহ পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।

৫৫ বছরের জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ছিল অতিতীক্ষè। জেলের নিয়মকানুন, কয়েদিদের জীবনযাপন ও জেলের ভিতরকার প্রতিটি কর্মকান্ড তিনি তীক্ষè নজরে লক্ষ্য করতেন। জেলখানায় বসে জেলজীবনের কথা লিখতেন। তাঁর এই অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের কথা লিখতেন। একবার জেলে থাকার সময় দুটো পাখি দেখেছিলেন। তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমের সঙ্গে এক চিলতে সবুজ ঘাসের মাঠ ছিল। তিনি সেখানে ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। বিকেলবেলা মাঠটুকুতে পায়চারি করতেন। পাখি দুটো দেখতেন। জেলের এক কয়েদি বঙ্গবন্ধুর খাবার-দাবারের তদারকি করত। তার দু-তিনটি মোরগ-মুরগি ছিল। মোরগটি ছিল খুব স্বাধীনচেতা। মাথা উঁচিয়ে দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করত। মোরগটির এই স্বাধীনচেতা মনোভাব বঙ্গবন্ধুর খুব ভালো লাগত। তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন। আগেরবার যে পাখি দুটোকে দেখেছিলেন পরেরবার আবার যখন জেলে গেলেন, সেই পাখি দুটো খোঁজলেন বঙ্গবন্ধু। তাদের আর দেখা পেলেন না। কী সুন্দর ও মায়াবী ভঙ্গিতে সেই পাখি দুটোর কথা লিখেছেন!

জেলজীবনের এরকম কত খুঁটিনাটি ঘটনা গভীর মমতায় লিখে গেছেন বঙ্গবন্ধু। জেলজীবন নিয়ে কত নেতা, কত লেখক কত লেখা লিখেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ এক অতুলনীয় বই। এই বইয়ের সঙ্গে অন্য কোনো লেখার তুলনা চলে না।

‘আমার দেখা নয়াচীন’ বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় বই। এ আসলে চীন ভ্রমণের কাহিনি। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসের ২ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত চীনের পিকিং শহরে ‘এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনে যোগদান করেন। নয়াচীন সফর করেন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী থাকা অবস্থায় কারাগারে বসে তিনি লেখেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই বই স্মৃতিনির্ভর ভ্রমণকাহিনি। আগের বই দুটোর মতো এই বইয়ের ভাষাও অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আগের বই দুটোতে যেমন এই বইতেও ঠিক তেমনভাবে ফুটে উঠেছে। সঙ্গে আছে তাঁর শিল্পিত মন আর অসামান্য দেশপ্রেম। আছে সংগ্রামী প্রত্যয়, সীমাহীন সৌন্দর্যপ্রিয়তা, জীবন সমাজ সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধদৃষ্টি। সবকিছু মিলিয়ে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার ৪৬টি ফাইলে প্রায় ৪০ হাজার পৃষ্ঠার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রচিত ১৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই ডকুমেন্টসকে বলেছেন ‘অমূল্য তথ্যভান্ডার’। যেন কয়লা খুঁড়ে পাওয়া হীরের খনি। আমাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ২২ সদস্যের একটি দল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার এই বিশাল তথ্যভান্ডার উদ্ধার করে। তাদের নিরলস পরিশ্রমে খন্ডে খন্ডে প্রকাশিত হয় সিক্রেট ডকুমেন্টস। সিক্রেট ডকুমেন্টসের প্রথম খন্ডের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘বাঙালি সবসময় বৈষম্যের শিকার ছিল আর এই বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেই তিনি সোচ্চার ছিলেন এবং আজন্ম-লড়াই সংগ্রাম করেছেন জাতির পিতা। এ কারণে মনে হয় তাঁর প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি বৈরী মনোভাব ছিল এবং এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থা সবসময় সক্রিয় ছিল। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কী বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সবসময় পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ রিপোর্ট তৈরি করত এবং রিপোর্ট পাঠাত আর এই রিপোর্ট যে পাঠাত তারই ওপর ভিত্তি করে তাঁর বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দেওয়া হতো এবং তাঁকে বারবার গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হতো। আমরা সন্তান হিসেবে খুব কম সময়ই তাঁকে কাছে পেয়েছি। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যই বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করেন। ধাপে ধাপে একটি জাতিকে তিনি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাঁরই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য, এ দেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু যে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন এবং তাঁকে প্রতিরোধ করার জন্য ধূর্ত পাকিস্তানিরা প্রতিটি মুহূর্তই যে সক্রিয় ছিল এই ডকুমেন্টস তার বড় প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু সেই নেতা, বাঙালির মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য একচুল ছাড় দেননি কোথাও। নিজের জীবনের সুখ-আনন্দ হাসিমুখে বিসর্জন দিয়েছিলেন দেশের জন্য। নিজের কথা ভাবেননি কখনই। শুধু ভেবেছেন দেশের কথা, শুধু ভেবেছেন বাঙালি জাতির মুক্তির কথা। আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু।

ছেলেবেলায় শালিক আর ময়নাপাখির ছানা পুষতেন বঙ্গবন্ধু। কুকুর, বানর পুষতেন। পশুপাখির প্রতি গভীর মমতা ছিল। ৫৫ বছরের জীবনে ১৩ বছরের বেশি জেলে কেটেছে তাঁর। কারাগারের দিনগুলোতেও প্রকৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করেছে। পাখিরা আকৃষ্ট করেছে। যে ওয়ার্ডে তাঁকে আটক করে রাখা হতো, তাঁর কামরার বাইরে তিনি বাগান করতেন। মাঠে ঘাস লাগাতেন। নিজ হাতে লাউ ঝিঙার বীজ লাগাতেন। সেইসব লতা বড় হয়ে উঠত আর তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন। বাগানের গাছে ফুল ফোটাতেন, নিজ হাতে যত্ন নিতেন গাছের। গাছ-লতা আর ঘাস তাঁর হাতে নতুন জীবন পেত। তাঁর হাতে বোনা গাছপালার মতো স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়ে আমরাও পেয়েছি নতুন জীবন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে সবজি আর ফুলবাগানের কথা লিখেছেন। মুরগি, কবুতর আর গভীর মমতায় লিখেছেন দুটো পাখির কথা।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে। সেখানে বসে দেখতেন একজোড়া মোরগ-মুরগি আর একটা বাচ্চা আপনমনে ঘুরে বেড়ায়। বাবুর্চি ওদের জোগাড় করেছে। নিজের খাবার থেকে খাবার বাঁচিয়ে সে ওদের দেয়। ছোট ছোট মাঠগুলোতে ঘাস লাগিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বৃষ্টি পেয়ে সেই মাঠ সবুজ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর লাগানো ফুলের চারাগুলো নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। খুব ভালো লাগে দেখতে। মোরগ-মুরগি তাদের বাচ্চাটা নিয়ে সেই মাঠে ঘুরে বেড়ায়।

মুরগিটা এক দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবুর্চির কাছে বঙ্গবন্ধু খবর নিতেন, মুরগিটা কেমন আছে? এক দিন মোরগটা জবাই করে দিতে চাইল বাবুর্চি। বঙ্গবন্ধু বললেন ‘দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভালো লাগে।’

বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালত। সেই কবুতরের বাচ্চা কোলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ওয়ার্ডের সামনের মাঠে আর বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের বেশ কয়েকবারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই তিনটির অসামান্য ভূমিকা লিখেছেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটির ভূমিকার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন;

‘মানুষের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও সংগ্রাম তিনি করেছেন যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন।

বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কিনা আমি জানি না।

ধাপে ধাপে মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। উজ্জীবিত করেছেন।

ছয় দফা ছিল সেই মুক্তি সনদ, সংগ্রামের পথ বেয়ে যা এক দফায় পরিণত হয়েছিল, সেই এক দফা স্বাধীনতা। অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিকল্পনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক শাসকগোষ্ঠী হয়তো কিছুটা ধারণা করেছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়েছিল।’

আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘গাছপালা, পশুপাখি, জেলখানায় যারা অবাধে বিচরণ করতে পারত তারাই ছিল একমাত্র সাথী। একজোড়া হলুদ পাখির কথা কী সুন্দরভাবে তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠেছে তা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না।’

সেই পাখি দুটোর কথা বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন এইভাবে...

১৮ জুন ১৯৬৬, শনিবার

‘বহুদিন পর্যন্ত দু’টি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত। আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দু’টি আসল না। ভাবলাম ওরা বোধহয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও দূরে চলে গিয়াছে। আর আসবে না। ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো। যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে একাকী থাকতাম তখন রোজই সকালবেলা লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বসতাম ওদের দেখার জন্য। মনে হল ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।’

শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদা বাঙালি পেয়েছে যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেই সংগ্রামে অনেক ব্যথা-বেদনা, অশ্র“ ও রক্তের ইতিহাস রয়েছে। মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহৎ অর্জন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

দিনের পর দিন কারাগারে থাকার ফলে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সে কথা পরিবারের কাউকে জানতে দিতেন না। বঙ্গমাতা ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাসে এক-দুবার জেলগেটে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। ছোট্ট রাসেল কিছুতেই আব্বাকে ছেড়ে আসতে চাইত না। মন খারাপ করত। কান্নাকাটি করত। বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠাতেন।

শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ডাকতেন ‘হাচু’ বলে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,

‘‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তাঁর আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।”

 

লেখক : কথাশিল্পী ও সম্পাদক কালের কণ্ঠ।

সর্বশেষ খবর