'ক্যালিপসো' নাচের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্রিস গেইলের কোমর দোলানো ছবি। ক্যারিবীয় ক্রিকেটারের মোহনীয় অঙ্গভঙ্গি। বর্তমান বিশ্বে ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন যেমন 'ক্যালিপসো', তেমনি নব্বইয়ের দশকে ফুটবলের সেরা বিজ্ঞাপন ছিল 'ব্যাকা ড্যান্স'! পশু শিকারের পর আফ্রিকান শিকারিরা বিশেষ ধরনের এই নৃত্যে মেতে ওঠেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে গোল করার পর 'ব্যাকা ড্যান্স' দিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন ক্যামেরুনের ৩৮ বছর বয়সী ফুটবলার রজার মিলা।
দ্বিতীয় রাউন্ডে কলাম্বিয়ার বিরুদ্ধে হারতেই বসেছিল ক্যামেরুন। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক রেনে হিগুয়েতার কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে দুর্দান্ত এক গোল করে সমতা ফেরান মিলা। ৩৫ গজ দূর থেকে শট করে বলকে পাঠিয়ে দেন প্রতিপক্ষের জালে। মিলার এই গোলেই ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় ক্যামেরুন। আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে অদম্য সিংহরা। আর অবিশ্বাস্য গোলটি করার পর মিলা দৌড়ে গিয়ে কর্নার ফ্ল্যাগ ধরে কোমর দুলিয়ে 'ব্যাকা ড্যান্সে' মেতে ওঠেন। রজার মিলার সেই উদযাপন ভঙ্গি সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোড়ন তোলে। কোমলপানীয় কোম্পানি কোকাকোলা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য মিলার সেই ছবি ব্যবহার করে। যদি '৯০-এর বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে লিনেকারের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেরে বিদায় নিতে হয় ক্যামেরুনকে। কিন্তু কলাম্বিয়ার বিরুদ্ধে মিলারের করা সেই অবিশ্বাস্য গোল এবং মোহনীয় 'ব্যাকা ড্যান্স' ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। কলাম্বিয়ার বিরুদ্ধে ওই ম্যাচে দু-দুটি গোল করে দলকে জিতিয়েছেন রজার মিলা। কিন্তু তার আগেও ম্যাচেও রুমানিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। একাই করেন দুই গোল। শুধু তাই নয়, সে আসরের প্রথম ম্যাচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে ক্যামেরুন। ওই ম্যাচেও নেপথ্য নায়ক রজার মিলা। '৯০-এর বিশ্বকাপে সব মিলে চার-চারটি গোল করে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান আফ্রিকান এই তারকা। ক্যামেরুনের ফুটবল ইতিহাসে রজার মিলা তো রূপকথার রাজকুমার! এখনো আফ্রিকান দেশটির অধিবাসীরা তাদের ছোট্ট ছেলেদের মিলার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখান। ফুটবলে মিলার প্রত্যাবর্তনটা সত্যিই অবিশ্বাস্য! ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে তিনি ক্যামেরুনের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন। কিন্তু সেবার সুবিধা করতে পারেননি মোটেও। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় ক্যামেরুন। '৮৬-র বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্বের খেলার যোগ্যতাই পায়নি আফ্রিকান দেশটি। মিলা ফুটবলকে গুডবাই জানিয়ে বুট চিরতরে উঠিয়ে রাখেন। '৯০-এর বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে যায় ক্যামেরুন। মিলা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ইতালিতে গিয়ে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখবেন আর ফুটবলারদের উৎসাহ দেবেন। কিন্তু হঠাৎ প্রেসিডেন্ট পল বিয়ারের ফোন, 'মিলা, তোমাকে বিশ্বকাপ দলে দেখতে চাই'। মিলা কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, 'স্যার, আমি তো অ-ব-স-র...' মিলাকে হালকা ধমকের সুরে প্রেসিডেন্ট বললেন, 'তোমাকে বিশ্বকাপ দলে দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ কথা।' দুম করে, ফোনের লাইনটা কেটে গেল! পরে বাধ্য হয়েই আবার ফুটবলে মনোনিবেশ করলেন। পরের ইতিহাস তো ফুটবলপ্রেমী মাত্রই জানা। প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে বধ। দ্বিতীয় ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে ধরাশায়ী রুমানিয়া। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় ওঠেই কলাম্বিয়ার বিরুদ্ধে মিলার ক্যারিশম্যাটিক দুই গোল।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে '৯৪-র বিশ্বকাপেও ক্যামেরুনের জার্সিতে মাঠে নামেন মিলা। তখন তার বয়স ৪২ পেরিয়েছে। যদিও সেবার খুব একটা নজর কাড়তে পারেননি তিনি। ক্যামেরুনও ভালো করতে পারেনি। তবে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় ব্যবধানে হারলেও একটি গোল করেন মিলা। আর এই গোলটির কারণে এখনো বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী গোলদাতা হিসেবে সোনার হরফে লেখা হয়ে যায় রজার মিলার নাম।
'অদম্য সিংহ' ক্যামেরুনের ছদ্মনাম, কিন্তু ভক্তদের কাছে রজার মিলা 'আফ্রিকান সিংহ' নামে পরিচিত। তিনি দু-দুবার বর্ষসেরা আফ্রিকান খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন, ১৯৭৬ ও ১৯৯০ সালে। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে ক্যামেরুনের হয়ে আফ্রিকান নেশনস কাপে দুবার শীর্ষ গোলদাতা হয়েছেন মিলা। ফিফার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ২০০৪ সালে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে ঘোষিত সর্বকালের সেরা ১২৫ জন জীবিত ফুটবলারের তালিকাতেও ছিল তার নাম। তবে ক্যামেরুন তারকা সবচেয়ে বড় খেতাবটি পান ২০০৬ সালে। আফ্রিকান ফুটবল সংস্থা (কাফ) ঘোষণা করে, রজার মিলা-ই বিংশ শতাব্দীর সেরা আফ্রিকান খেলোয়াড়।