বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ওয়ানডে ক্রিকেটে। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ক্রিকেটাররা রঙিন পোশাকে খেলতে নামে। আরও বেশ কয়েকটি 'প্রথম'-এর উদ্ভব হয়েছিল সেই আসরে। রঙিন বলের পরিবর্তে খেলা হয় 'সাদা' বলে। তবে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, ফ্লাড লাইটের আলোয় খেলার বিষয়টি। আইসিসির এমন সিদ্ধান্তে তো মহাখুশি দর্শকরা। সারা দিন অফিস করে রাতে খেলা দেখার অপূর্ব সুযোগ। কালো সাইটক্রীনের প্রচলনও শুরু হয়ে যায়। অনেক 'নতুনে'র জন্ম দেওয়া সেই বিশ্বকাপে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পেয়ে যায় 'নতুন' এক দলকে- পাকিস্তান।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সবুজ উইকেটে পাকিস্তানি পেসাররা আগুন ঝরা বোলিং করে ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ব্যাটসম্যানরা দুর্দান্ত ব্যাটিং করলেও সেবার পাকিস্তান বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল মূলত বোলারদের জাদুতেই। ১৮ উইকেট নিয়ে ওই আসরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বোলারের পুরস্কার লাভ করেন ওয়াসিম আকরাম। স্পিনে জাদু দেখিয়েছেন মুশতাক আহমেদ। বাউন্সি ও দ্রুত গতির উইকেটে কব্জির জাদু দেখিয়ে পাক স্পিনার ৯ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট। এছাড়া অধিনায়ক ইমরান খান ও আকিব জাভেদের বলে তো আগুন ছিলই।
পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরাও কিন্তু কম যান না! ৯ ম্যাচে জাভেদ মিয়াঁদাদ ব্যাট হাতে করেছিলেন ৪৩৭ রান, আসরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। সর্বোচ্চ ৪৫৬ রান করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। সেরা পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে পাকিস্তানের আরেক ব্যাটসম্যান ছিলেন-রমিজ রাজা।
ঘরের মাঠে সেবার ব্যর্থ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা। আগের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বলে 'ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া'ও যেন অনেকটা স্রোতে গা ভাসিয়ে ছিল। তাই ক্রিকেটাররাও নিজেদের সেরাটা দিতে ব্যর্থ হন। তাই ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল- ঘরের মাঠে সেমিফাইনালে উঠতে পারল না স্বাগতিকরা। ঠিক আগের আসরে একই অবস্থা হয়েছিল তখনকার চ্যাম্পিয়ন ভারতের। তবে অস্ট্রেলিয়া ব্যর্থ হলেও আরেক স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের তখন দুর্দান্ত প্রতাব। গ্রুপ পর্বে তারা সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে সেরা দল হয়েই সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছিল। একমাত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ছাড়া তারা কারো বিরুদ্ধেই হারেনি।
এগিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উইকেটে এশিয়ার তিন প্রতিনিধি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থা যাচ্ছেতাই! তবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা পরের রাউন্ডে যেতে না পারলেও গ্রুপের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় এক জয় দিয়ে কোনো রকমে টেনে টুনে সেমির দরজায় পৌঁছে যায় ইমরানের দল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই ম্যাচে চার উইকেট নিয়ে কিউই ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিলেন ওয়াসিম আকরাম। আর ব্যাটিংয়ে অপরাজিত এক সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানকে সহজ জয় এনে দিয়েছিলেন রমিজ রাজা। কিন্তু ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন মুশতাক আহমেদ। কারণ মাত্র দুই উইকেট শিকার করলেও ১০ ওভার বোলিং করে মাত্র ১৮ রান দিয়েছিলেন তিনি।
সেমিফাইনালেও নিউজিল্যান্ডকে অবাক করে দিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। ওই ম্যাচে মার্টিন ক্রোর দাপুটে ব্যাটিংয়ে ২৬২ রান করেছিল নিউজিল্যান্ড। পরে বোলাররাও দারুণ বোলিং করছিলেন। পাকিস্তানিদের রান নেওয়ার তেমন সুযোগই দিচ্ছিলেন না। একটা সময় মনে হচ্ছিল কিউইদের জয়টা যেন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু পাকিস্তানের ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ইনজেমাম উইকেটে যাওয়ার পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মাত্র ৩৭ বলে ৬০ রানের সাইক্লোন ইনিংস খেলে ইনজি পাকিস্তানকে পৌঁছে দেন ফাইনালে। অশ্রুসজল নয়নে মাঠ ছাড়েন মার্টিন ক্রো। দুর্দান্ত ব্যাটিং করে দলকে জয় এনে দিতে না পারলেও আসরে সেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন তিনিই।
অন্যদিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই সেমিফাইনালে উঠে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু ইংলিশদের বাঁধা আর টপকাতে পারল না প্রোটিয়ারা। তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে পৌঁছে যায় গ্রাহাম গুচের দল। বিশ্বকাপের পঞ্চম আসরে তৃতীয়বারের মতো ফাইনাল খেলা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! তবে ইংলিশদের দৃষ্টি শিরোপার দিকে। ফাইনালে ইয়ান বোথাম, ডেরেক প্রিঙ্গলরা ২৪৯ রানে পাকিস্তানকে আটকে দিলে শিরোপা উদযাপনের প্রস্তুতি নিতে থাকে ইংলিশ ভক্তরা। কিন্তু ইংলিশদের পার্টি পণ্ড করে দেন ওয়াসিম আকরাম ও মুশতাক আহমেদ। পেস স্পিন বোলিং কম্বিনেশনে ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় ২২৭ রানে। ২২ রানের এক স্বপ্নিল জয় পায় ইমরানের দল। 'অস্ট্রেলিয়া জয়' করে পাকিস্তান।