রেফারির বাঁশি বাজতেই পুরো স্টেডিয়াম যেন ভেঙে পড়ল গগনবিদারী আওয়াজে! চারদিকে লাখো ভোল্টে উচ্চকিত বাংলাদেশ! বাংলাদেশ শব্দ। হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমীর গগনবিদারী আওয়াজে ভাষার মাসে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে 'ল্যাপ অব অনার' দেন মামুনুল, এমিলি, ভিনসেন্ট, জাহিদরা। তখন প্রিয় ফুটবলারদের ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নেন দর্শকরা মুহুর্মুহু করতালিতে। এ এমন এক মুহূর্ত, যার অপেক্ষায় ছিল গোটা দেশ, ১৬ কোটি ক্রীড়ানুরাগী। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের এমন উচ্ছ্বাস-উৎসব হারিয়েই গিয়েছিল। ঠাঁই নিয়েছিল স্মৃতির খাতায়। কাল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের স্বপ্নের ফাইনালে ওঠায় ফিরে এলো সেই উন্মাদনা! বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের তৃতীয় আসরের ফাইনালে প্রিয় জন্মভূমিকে টেনে তোলেন নাসির উদ্দীন অসাধারণ এক গোলে। এই জয়ে ১৯৮৯ সালের পর ঘরের মাঠে কোনো ফিফা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে ফের উঠল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ফাইনাল কাল। প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়া।
বাংলাদেশ এবারই প্রথম কোনো ফাইনালে উঠল না। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের ফাইনালে টাইব্রেকারে বাংলাদেশ লাল দল দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে আমন্ত্রণমূলক চার জাতির টুর্নামেন্টেও শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে হারিয়ে জিতেছিল সোনা। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন।
ভাষার মাস। ঋতুতেও পরিবর্তনের আভাস। বাতাসে ফাগুনের মিষ্টি মধুর আবেদন। প্রাণমাতানো, মনভোলানো এমন পরিবেশে মামুনুলরা মাঠে নেমেছিলেন চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। ফাইনালের প্রতিজ্ঞা! প্রতিজ্ঞা রেখেছেন জানবাজি ফুটবল খেলে। হারিয়েছেন টেকনিক্যালি এগিয়ে থাকা থাইল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে। অথচ থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বরাবরই তলানিতে। থাই জাতীয় দলের বিপক্ষে এর আগে মাত্র দুবার জিতেছে বাংলাদেশ এবং ড্র দুবার। হার নয়বার। সর্বশেষ দুই দলের মুখোমুখিতে বড় ব্যবধানের (৫-০) হারের তিলক পরেছিল বাংলাদেশ। সেসব পরিসংখ্যান যখন সামনে, তখন পেছনে হাঁটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাপুটে ফুটবল খেলে মামুনুলরা সরাসরি জয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ফাইনালে।
প্রথম ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে হারায় সেমিফাইনালে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছিল মামুনুলদের জন্য। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি হয়ে পড়েছিল জীবনবাজির। সেই লড়াইয়ে হেমন্তের অসাধারণ গোলে সেমিতে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। সেমিতে জায়গা নেওয়ার পর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় মামুনুলদের। সেই কঠিন স্বপ্ন বাস্তবায়নে হাজার পঁচিশেক দর্শকের সমর্থন নিয়ে খেলতে নামে বাংলাদেশ। দর্শকভরা স্টেডিয়ামের পরিচিত মাঠে শুরু থেকে থাই রক্ষণভাগের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকেন মামুনুলরা। রেফারির বাঁশি বাজার ছয় মিনিটে প্রথম আক্রমণে যায় লাল-সুবজ জার্সিধারীরা। অধিনায়ক মামুনুল ডি বঙ্রে মাথা থেকে বাঁ পায়ে শট নেন, কিন্তু লক্ষ্য ঠিক ছিল না। ওই আক্রমণের পর গতিশীল ফুটবল খেলতে থাকে বাংলাদেশের ফুটবলাররা। ১৮ মিনিটে অবশ্য পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছিল থাইল্যান্ড। কিন্তু বিপদে ফেলেনি পাকোর্নের ফ্রি কিক। দুই মিনিট পর প্রতি আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন জাহিদ। কিন্তু ম্যাচসেরা জাহিদের ক্রসটিকে কাজে লাগাতে পারেননি দুই স্ট্রাইকার জাহিদ হোসেন এমিলি ও হেমন্ত। অবশেষে ৪০ মিনিটে স্বপ্ন নেমে আসে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে। স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শককে উৎসব-উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে গোল করেন রক্ষণভাগের মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। গোলটির কারিগর অধিনায়ক মামুনুল। ডানপ্রান্ত থেকে বাঁ পায়ের সোয়ার্ভিং কর্নারে থাই রক্ষণভাগকে বোকা বানিয়ে যখন গোলপোস্টের দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই ডান পায়ে ট্যাপ করে গোল করে নাসির বাকরুদ্ধ করে দেন থাইল্যান্ডকে (১-০)। ঘরোয়া ফুটবলে গোলে থাকলেও বাংলাদেশের জার্সি গায়ে এটাই প্রথম। খেলার একমাত্র গোলটি হয় প্রথমার্ধে। এগিয়ে থাকায় দ্বিতীয়ার্ধে ফরম্যাটে কিছুটা পরিবর্তন আনেন কোচ লোডভিক। সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার জামাল ভুঁইয়াকে উপরে উঠতে নিষেধ করে দেন। ফলে প্রতি আক্রমণ বেড়ে যায় থাইল্যান্ডের। এর মধ্যে ৬৪ মিনিটে গোল প্রায় হয়েই গিয়েছিল। বাঁ প্রান্ত থেকে থাই অধিনায়ক পাকোর্নের ডান পায়ের সোয়ার্ভিং শটে সম্পূর্ণ পরাস্ত হন গোলরক্ষক শহীদুল। কিন্তু ক্রসপিঠ বাঁচিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। এর পর অবশ্য আর কোনো সমস্যা হয়নি বাংলাদেশের। মন ভরিয়েই উপরে ওঠে যায় বাংলাদেশ। এখন শুধু শিরোপা জেতার অপেক্ষা।
২০১৩ সালের জুনে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম বাংলাদেশ ফাইনালে উঠল ক্রুইফের কোচিংয়ে। তাই ম্যাচ শেষে চাপমুক্ত উচ্ছ্বসিত ক্রুইফ জড়িয়ে ধরেন প্রিয় শিষ্যদের। ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম জয়ের উচ্ছ্বাসে আবেগে কেঁদেও ফেলেন। ২০০৩ সালে তিনি ম্যানেজার থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।