ম্যাচ শেষ হতে তখনো মিনিট পাঁচেক বাকি। উন্মাতাল গর্জনে তখন কাঁপছে গোটা সিলেট জেলা স্টেডিয়াম। গগনবিদারি 'বাংলাদেশ' 'বাংলাদেশ' স্লোগানে কানপাতা দায়। যেন ম্যাচ তখনই জিতে গেছে বাংলাদেশ। আর এ যেন জয়ের উল্লাস। বাকি পাঁচ মিনিটে ঘটেনি কোনো অঘটন। মরিয়া ভারত পারেনি ম্যাচের ৮৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সমতায় ফিরতে। আর তাই পাঁচ মিনিট আগে থেকেই জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা স্টেডিয়াম ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার সময়ও ছিল উল্লাসে মুখর। ভারতকে ২-১ গোলে গুঁড়িয়ে দিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষের অপেক্ষায় এখন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচেই দর্শক উত্তাপের বিষয়টি টের পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে যে দর্শকদের বাঁধভাঙা জোয়ার থাকবে, তা সেই ম্যাচেই বোঝা গিয়েছিল। হলোও তাই। গতকাল বিকালে বাংলাদেশ-ভারত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ম্যাচে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। ম্যাচের শুরু থেকে দর্শকদের উল্লাসধ্বনি বিরতিহীনভাবে চলেছে শেষ পর্যন্ত। বৃথা যায়নি দর্শকদের উল্লাস। তাদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনের দারুণ এক জয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিদান দিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ তারকারা। অসাধারণ গৌরবময় এক জয়ে হাসিমুখে স্টেডিয়াম ছেড়েছেন দর্শকরা।
ম্যাচের শুরুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আক্রমণাত্মক থাকা বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ম্যাচের মিনিট বিশেক পরেই যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশের আসল রূপ। একের পর এক আক্রমণে কাঁপতে থাকে ভারতের রক্ষণভাগ। প্রথমার্ধের ১৩ মিনিটে বাংলাদেশের ফাহিম মোর্শেদ মাঝমাঠ থেকে বল বাড়ান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলা সরওয়ার জামান নিপুকে। ভারতের দুই ডিফেন্ডারের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলেও পোস্টে নেওয়া শটটি দুর্বল ছিল নিপুর। ২১ মিনিটে খলিল ভুঁইয়ার ক্রসে ভারতের পোস্টের সামনে ফাহিম মোর্শেদ মাথা ছোঁয়াতে ব্যর্থ হন। ২৪ মিনিটে ভারতের লালদিনপুইয়ার ক্রস থেকে মোহাম্মদ শাহজাহানের দুর্বল শট সহজেই গ্লাভস বন্দী করেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক ফয়সল আহমেদ। ২৫ মিনিটে সম্মিলিত এক আক্রমণ থেকে ডি-বক্সে ভিতর থেকে এলোমেলো শট নেন ভারতের লালদিনপুইয়ার।
প্রথমার্ধের ৩৪ মিনিটে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অল আউট আক্রমণে ওঠে বাংলাদেশ। ডান উইং থেকে মোস্তাফিজ খানের ক্রস ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হয় ভারতের ডিফেন্স। বল পেয়ে দুর্দান্ত এক শটে গোল করার কাজটা ঠাণ্ডা মাথায় সারেন মোহাম্মদ শাওন। উল্লাসে ফেটে পড়ে স্টেডিয়াম। প্রেসবঙ্ থেকে সেই উত্তাপের অাঁচ যেন অনুভব করা যাচ্ছিল অতিসহজেই! প্রথমার্ধের ৪০ মিনিটে ভারতের মোহাম্মদ শাহজাহানকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন বাংলাদেশ দলপতি শাওন হোসেন। ৪৩ মিনিটে আরেকটি সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতের রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে সাদ উদ্দিন চমৎকার এক মাইনাস করেন মোহাম্মদ শাওনকে। কিন্তু শাওনের উড়ন্ত বল চলে যায় পোস্টের বাইরে দিয়ে।
প্রথমার্ধে এক গোল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুটা যেন প্রথমার্ধের পুনরাবৃত্তি। মিনিট দশেক নিজেদের অর্ধেই ঘুরাফেরা আর ভারতীয় আক্রমণ ঠেকাতেই ব্যস্ত সময় কাটায় বাংলাদেশ। ম্যাচের ৪৯ মিনিটে বাংলাদেশের ডিফেন্সের ভুলে ভারতের রাহিম আলী বল নিয়ে ঢুকে পড়েন বক্সে। ডিফেন্সের চেয়েও বড় ভুল ছিল গোলরক্ষক ফয়সল আহমদের। তিনি পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসায় সহজেই গোল করে ভারতকে সমতায় ফেরান রাহিম আলী। এরপর যেন হুঁশ ফিরে বাংলাদেশের। রক্ষণাত্মক খোলস ছেড়ে আক্রমণের পসরা সাজায় বাংলার কিশোররা। ম্যাচের ৫৯ মিনিটে বাংলাদেশের সাদ উদ্দিনকে ঠেকাতে গিয়ে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন ভারতের মোহাম্মদ শাহজাহান। ম্যাচের ৬০ মিনিটে দারুণ এক সুযোগ ছিল বাংলাদেশের জন্য। সাদ উদ্দিনের চমৎকার মাইনাসে বক্সে একেবারে ফাঁকায় দাঁড়িয়েও পোস্টের বাইরে দিয়ে বল পাঠান সরওয়ার জামান নিপু।
ঠিক এক মিনিট পর অল্পের জন্য বিপদ থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ গোলরক্ষক ফয়সল আহমদ ব্যাক পাস ক্লিয়ার করতে গিয়ে বলে শট নিতে ব্যর্থ হন। তার পায়ের ফাঁক গলে বল চলে যায় পোস্টের বাইরে। তবে কর্নারকে কাজে লাগাতে পারেনি ভারত। ম্যাচের ৭৫ মিনিটে বাংলাদেশকে আবারও নিশ্চিত গোল থেকে বঞ্চিত করেন সেই সরওয়ার জামান নিপু। ফাহিম মোর্শেদের ডিফেন্স চেরা পাস ধরে ভারতীয় গোলরক্ষককে একা পেয়েও বল হাতে তুলে দেন নিপু।
ম্যাচের ৮৫ মিনিট। আক্রমণে ওঠে বাংলাদেশ। বল পেয়ে দ্রুত ভারতের বঙ্ েঢুকেন নিপু। পোস্টে শট নেওয়ার মুহূর্তে তাকে ফাউল করে বসেন ভারতের আয়মল। পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে ভুল করেননি রেফারি। সহজ সুযোগকে গোলে পরিণত করতে ভুল হয়নি বাংলাদেশের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামানেরও। ২-১ গোলে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখে তখন পুরো স্টেডিয়াম উন্মাতাল। 'বাংলাদেশ' 'বাংলাদেশ' এই স্লোগান শেষ পর্যন্ত ধরে রেখে ভারতবধের মহাকাব্য দেখে স্টেডিয়াম ছাড়েন দর্শকরা।