শিরোনাম
সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রামমোহন রায়ের যুক্তি

সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রামমোহন রায়ের যুক্তি

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথানুসারে, “হেস্টিংস প্রেসের যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তা অপহৃত হল।”

 

“ভারতবর্ষে মধ্যযুগের অবসান আর তাহার আধুনিক যুগের সূচনা ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন তারিখে।” (সরকার ১৯৭৬ : ৪৯৭) ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্যার যদুনাথ সরকারের এই উক্তির সহিত আগে পরে অনেকেই একমত হইতে পারেন নাই। দৃষ্টান্তের মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনচরিতকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, “আধুনিক বাংলাদেশের জন্ম হয় সেদিন-যেদিন মুদ্রাযন্ত্র আবির্ভূত হল হুগলি [জেলার] শ্রীরামপুরে ও কলিকাতায়।” প্রভাতকুমার সঙ্গে সঙ্গে আরো যোগ করিয়াছেন, “আর বাঙালীর নবজন্ম বা দ্বিজত্ব-লাভ হল সেদিন-যেদিন সাময়িক পত্র প্রকাশিত হল, প্রথমে ইংরেজিতে পরে বাংলাতে।” নিছক সততার কারণে বলুন আর ধুরন্ধর সরলতার গুণে বলুন, প্রভাতকুমারের এই স্বীকারোক্তিটি বড়ই মূল্যবান পদার্থ হইয়াছে : “পত্রিকা-পরিচালনার আদর্শ ও টেক্নিক আমরা ব্রিটনদের কাছ থেকেই পাই এবং আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্য আদর্শে পত্রিকা পরিচালনা করছি।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১০৭)

ওয়াকেবহাল মহলের মতে, ভারতবর্ষে প্রকাশিত প্রথম (বলাবাহুল্য, ইংরেজি) সংবাদপত্রের নাম ‘বেঙ্গল গেজেট’। সম্পাদক জেমস্ অগস্টাস হিকির নামানুসারে লোকমুখে ইহা ‘হিকির গেজেট’ বা জার্নাল নামেই অধিক প্রসিদ্ধ ছিল। প্রচার আছে, ইহার প্রথম সংখ্যা ছাপা হইয়াছিল ১৭৮০ সালের ২৯শে জানুয়ারি তারিখে। প্রায় আড়াই বছর চলার পরে-১৭৮২ সালের মার্চ মাসে-এই পত্রিকাটি বন্ধ হইয়া যায়। যে ছাপাখানায় পত্রিকাটি ছাপা হইত তাহা সরকারে বাজেয়াপ্ত হয় আর সম্পাদকের কপালে জোটে কারাদ-।

১৭৯১ সালে কলিকাতায় উইলিয়াম ডুয়ানি নামে জনৈক আইরিশ-আমেরিকান ভদ্রলোক ‘বেঙ্গল জার্নাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই কাগজ বন্ধ হইবার পর ১৭৯৪ সাল হইতে ভদ্রলোক ‘ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড ট্রেডসম্যান’ [ভারতবর্ষীয় সমাজ ও বৃত্তিজীবী) নামে আরেকটি সাপ্তাহিক কাগজ প্রকাশ করিতে থাকেন। ইনি শ্বেতাঙ্গ হইয়াও শ্বেতাঙ্গ এয়ুরোপিয়া-ব্যবসায়ীদের কোপদৃষ্টিতে পড়িয়াছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় নিরুত্তাপ ভাষায় বলিতেছেন, “এ পত্রিকাও বন্ধ হয় তাঁর সবর্ণ লোকদের অনুগ্রহে।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১১১)

এক্ষণে প্রভাতকুমারের বিবরণ হইতে অধিক ধার করিয়া লিখি : “একদিন তাঁকে লাটভবনে ডেকে আনা হয় এবং সেখানেই বন্দী করা হয়। ডুয়ানিকে কী অপরাধে নির্বাসিত করা হয় তা তিনি জানতে পারেন নি এবং তাঁর লক্ষাধিক টাকার সম্পত্তিই বা কেন বাজেয়াপ্ত করা হয় তাও তাঁর অজ্ঞাত থেকে যায়। এইভাবে অষ্টাদশ শতকে কোম্পানির শাসনের গোড়ার দিকে পত্রিকা-শাসন কাজ চলত।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১১১)

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিককার খ্যাতনামা পত্রিকা-সম্পাদক ধুরন্ধর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, “একেবারে আদি হইতেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষগণ সংবাদপত্রের জগতকে সুনজরে দেখিতেন না। সম্পাদকগণকে ধমক দেওয়া হইত আর হেনস্তা করা হইত, আর তাহাদিগের কার্যক্রমে সৃষ্টি করা হইত সাংঘাতিক বাধার। যাঁহারা ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তাঁহারা কোন ধরনের বিরুদ্ধাচার বা ভিন্নমত সহ্য করিতে পারিতেন না। কখনও কখনও একান্ত নির্দোষ সংবাদ প্রকাশের কারণেও সম্পাদকদিগকে দ- প্রদান করা হইত। ইংরেজি সন ১৭৯১ হইতে সন ১৭৯৯ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন সম্পাদককে কোন প্রকার মামলা রুজু না করিয়াই জোরপূর্বক এয়ুরোপে পাঠাইয়া দেওয়া হইত। আরও অনেক অনেককে ভর্ৎসনা করিয়া ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করা হইত।” (চ্যাটার্জি ১৯২৯ : ১৬১)

ব্রিটিশ শাসনের ঐ যুগে পত্রিকা-শাসন সংক্রান্ত আইন ও নিয়মের সকল বিধি-বিধান সবিস্তার আলোচনার স্থান এখানে নাই। এস্থলে মাত্র দুইটি আইনের উল্লেখ করিলেই আমাদের শান্তি হইবে। বড়লাট ওয়েলেসলির আমলের-মোতাবেক ১৭৯৯ সালের-একটি আইনে বলা হয়, “সরকার বাহাদুরের সচিব কিংবা তাঁহার দ্বারা এতদ্বিষয়ক কর্ম সম্পাদনার্থে নিয়োজিত ব্যক্তির হাতে পরীক্ষিত হইবার আগে কোন সংবাদপত্র প্রকাশ করা যাইবে না।” সঙ্গে সঙ্গে ইহাও জানানো হয়, “যদি কেহ উপরের যে কোন বিধান বা নিয়ম অমান্য করেন তবে তাহাকে সঙ্গে সঙ্গেই এয়ুরোপগামী জাহাজে উঠাইয়া দেওয়া হইবে।” (চ্যাটার্জি ১৯২৯ : ১৬১)

স্বভাবতই বোঝা যায়, ১৭৯৯ সালের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের শর্ত মানিয়া পত্রিকা চালানো শক্ত হইয়া পড়িল। পত্রিকা ছাপার আগে পান্ডুলিপি বা প্রুফ পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হইত। তাহার পর ফিরিয়া আসিলে পত্রিকা ছাপা চলিত। ফলে পাদরি মার্শম্যান সাহেবের ভাষায়, “সম্পাদকীয় মন্তব্যের স্থলে সংবাদপত্রের অনেক স্তম্ভই তারকাচিহ্নিত হইয়া বাহির হইত; কেননা সে-সকল অংশে ‘সেন্সর’ তাহার সাংঘাতিক কলম চালাইতেন। শেষ মুহূর্তে শূন্য অংশগুলি পূরণ করিয়া দেওয়া সম্ভব হইত না।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১১২) এই দীর্ঘ কাহিনী হ্রস্ব করিয়া বলিতেছি। এই কঠিন অবস্থা ১৮১৮ পর্যন্ত চলিয়াছিল। ঐ বছরের মাঝামাঝি (১৯ আগস্ট নাগাদ) সরকার সেন্সর বা সংবাদপত্র-পরীক্ষক নিয়োগ প্রথার অসারতা উপলব্ধি করিয়া তাহার জায়গায় সম্পাদকদের শাসন করিবার নিমিত্ত কতক কতক সাধারণ আইন ও নিয়ম জারি করিলেন। এই সময় সরকারের বড় কর্তা ছিলেন মার্কুইস হেস্টিংস। তিনি ১৮২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৮১৮ সালের নতুন নিয়মাবলি প্রবর্তনের পর নতুন এক কেলেংকারি রটিয়া গেল। ঐ বছর অক্টোবর মাসের ২রা তারিখ হইতে জেমস সিল্ক বাকিংহাম নামক এক ইংরেজ ভদ্রলোকের সম্পাদনায় ‘দি ক্যালকাটা ক্রোনিকল অব পলিটিকাল, কমার্শিয়াল অ্যান্ড লিটারারী গেজেট’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। এই পত্রিকা সংক্ষেপে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। কিছু দিন পরে ইহা সপ্তাহে দুইবার করিয়া বাহির হইতে শুরু করে। বড়লাট লর্ড হেস্টিংস দেশে ফিরিয়া গেলে ১৮২৩ সালের গোড়ার দিকে ভারপ্রাপ্ত বড়লাট জন অ্যাডাম ক্যালকাটা জার্নালের সম্পাদক জেমস সিলক বাকিংহামের ভারতবর্ষে থাকার লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র বাতিল করিয়া তাঁহাকে এয়ুরোপ পাঠাইয়া দিলেন। শুদ্ধ তাহাই নহে, ১৮২৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ইংরেজ সরকার নতুন একপ্রস্ত সংবাদপত্র শাসন আইন জারি করিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথানুসারে, “হেস্টিংস প্রেসের যেটুকু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তা অপহৃত হল।” অধিক কি, “নূতন আইন ১৭৯৯ অব্দে ওয়েলেসলি-কৃত প্রেস-আইনেরই পুনরুক্তি, তবে আরো কড়া ও বিস্তারিত।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১১৭-১১৮)

আমরা যতদূর দেখিলাম, নতুন সংবাদপত্র শাসন আইনটির কোপানলে প্রথম পড়িয়াছিল ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ নামের ইংরেজি পত্রিকাটি। এই পত্রিকা ১৮২৩ সালের ১০ই নবেম্বর নাগাদ বন্ধ হইয়া যায়। এই ঘটনার প্রভাব অন্যান্য পত্রিকার উপরও না পড়িয়া যায় নাই। এখানে বলিয়া রাখা যাইতে পারে, কলিকাতায় প্রথম ইংরেজি ছাপাখানা বসানো হয় ১৭৮০ সালে। তবে ইহার দুই বছর আগেই-মোতাবেক ১৭৭৮ সালে-হুগলিতে বাংলা মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৮ সালের আগে ভারতবর্ষের কোথায়ও কোন বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হইয়াছিল এমন খবর আমাদের জানা নাই। ঐ বছরের এপ্রিল-মে মাসে তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইহাদের মধ্যে ‘দিগদর্শন’ মাসিক, ‘সমাচার দর্পণ’ সাপ্তাহিক আর ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ মাসিক।

রামমোহন রায় কলিকাতা হইতে ১৮২১ সালে দুইটি পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। একটি বাংলা সাপ্তাহিক-নাম ‘সম্বাদ কৌমুদী,’ অন্যটি মাসিক, বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই-নাম ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (ইংরেজিতে ‘ব্রাহ্মণিকাল ম্যাগাজিন’)। পরের বছর-অর্থাৎ ১৮২২ সালে তিনি প্রকাশ করেন ফারসি সাপ্তাহিক ‘মিরাতুল আখবার’। এই পত্রিকাটি প্রায় এক বছর চলিয়াছিল। ১৮২৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে রামমোহন রায় নতুন সংবাদপত্র শাসন আইনের প্রতিবাদস্বরূপ ‘মিরাতুল আখবার’ বন্ধ করিয়া দিলেন।

রামমোহন রায়ের সম্পাদকীয় নিবন্ধ হইতে (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যাহার অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছেন) কিছু এখানে উদ্ধৃত করিতেছি। রামমোহন রায় লিখিতেছেন, “পূর্বেই জানান হইয়াছিল যে, সকৌন্সিল মহামান্য গবর্নর-জেনারেল কর্তৃক একটি আইন ও নিয়ম প্রবর্ত্তিত হইয়াছে, যাহার ফলে অতঃপর এই নগরে পুলিস আপিসে স্বত্বাধিকারীর দ্বারা হলফ না করাইয়া ও গবর্মেন্টের প্রধান সেক্রেটরির নিকট হইতে লাইসেন্স না লইয়া কোন দৈনিক, সাপ্তাহিক বা সাময়িক পত্র প্রকাশ করা যাইবে না এবং ইহার পরও পত্রিকা সম্বন্ধে অসন্তুষ্ট হইলে গবর্নর-জেনারেল এই লাইসেন্স প্রত্যাহার করিতে পারিবেন। এখন জ্ঞাত করা যাইতেছে যে, ৩১-এ মার্চ তারিখে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মাননীয় স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকনটেন এই আইন ও নিয়ম অনুমোদন করিয়াছেন। এই অবস্থায় কতকগুলি বিশেষ বাধার জন্য মনুষ্য-সমাজে সর্বাপেক্ষা নগণ্য হইলেও আমি অত্যন্ত অনিচ্ছা ও দুঃখের সহিত এই পত্রিকা (মীরাৎ-উল্-আখ্বার) বন্ধ করিলাম।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪, পৃ. ১৩২-৩৩)

ঐ সম্পাদকীয় নিবন্ধে রামমোহন রায় তিনটি বাধার কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন। প্রথম বাধার সহিত জাতীয় সাম্যের সম্বন্ধ প্রত্যক্ষ। পরাধীন দেশে অধস্তন জাতির লোকজন যে প্রভুজাতির কাছে সামাজিক সাম্যের আশা করিতে পারে না তাহাতে রামমোহনের কোন বিভ্রম ছিল না। তিনি লিখিয়াছিলেন, “প্রথমতঃ প্রধান সেক্রেটরির সহিত যে-সকল ইউরোপীয় ভদ্রলোকের পরিচয় আছে, তাহাদের পক্ষে যথারীতি লাইসেন্স গ্রহণ অতিশয় সহজ হইলেও আমার মত সামান্য ব্যক্তির পক্ষে দ্বারবান্ ও ভৃত্যদের মধ্য দিয়া এই রূপ উচ্চপদস্থ ব্যক্তির নিকট যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ; এবং আমার বিবেচনায় যাহা নিষ্প্রয়োজন, সেই কাজের জন্য নানা জাতীয় লোকে পরিপূর্ণ পুলিস আদালতের দ্বার পার হওয়াও কঠিন।”

রামমোহন রায়ের দ্বিতীয় যুক্তির সহিত সামাজিক সুবিচারের প্রশ্নটি বিজড়িত। তিনি লিখিলেন, “দ্বিতীয়তঃ প্রকাশ্য আদালতে সম্ভ্রান্ত বিচারকদের সমক্ষে স্বেচ্ছায় হলফ করা সমাজে অত্যন্ত নীচ ও নিন্দার্হ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। তাহা ছাড়া সংবাদপত্র-প্রকাশের জন্য এমন কোন বাধ্যবাধকতা নাই, যাহার জন্য কাল্পনিক স্বত্বাধিকারী প্রমাণ করিবার মত বেআইনি ও গর্হিত কাজ করিতে হইবে।”

পরিশেষে বলিব, রামমোহন রায়ের তৃতীয় যুক্তিটি মানবিক মর্যাদার সহিত অবিচ্ছেদ্য। তিনি লিখিয়াছিলেন, “তৃতীয়তঃ অনুগ্রহ প্রার্থনার অখ্যাতি ও হলফ করিবার অসম্মানভাজন হইবার পরও গবর্মেন্ট কর্ত্তৃক লাইসেন্স প্রত্যাহৃত হইতে পারে, এই আশঙ্কার জন্য সেই ব্যক্তিকে লোকসমাজে অপদস্থ হইতে হইবে এবং এই ভয়ে তাহার মানসিক শান্তি বিনষ্ট হইবে। কারণ, মানুষ স্বভাবতই ভ্রমশীল; সত্য কথা বলিতে গিয়া তাহাকে হয়ত এরূপ ভাষা প্রয়োগ করিতে হইবে, যাহা গবর্মেন্টের নিকট অপ্রীতিকর বিবেচিত হইতে পারে। সুতরাং আমি কিছু বলা অপেক্ষা মৌন অবলম্বন করাই শ্রেয় বিবেচনা করিলাম।” (প্রভাতকুমার ১৩৯৪ : ১৩৩-১৩৪)

১৯৭২ সনে প্রবর্তিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পাঠ করিলেও প্রত্যয় হয়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সত্য কথাই বলিয়াছিলেন, “পত্রিকা-পরিচালনার আদর্শ ও টেক্নিক আমরা ব্রিটনদের কাছ থেকেই পাই এবং আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্য আদর্শে পত্রিকা পরিচালনা করছি।” পত্রিকা-শাসনের আইন আর নিয়মাবলিও কি তাহাদের কাছেই পাওয়া নহে?

বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজিত ৩৯ (২) ধারায় উল্লেখ আছে, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।” পাঠিকা লক্ষ করিয়া থাকিবেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’ কথাটির ইংরেজি তর্জমাস্বরূপ ‘ফ্রিডম অব দি প্রেস’ কথাটি বাছাই করা হইয়াছে। আর যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধগুলির তালিকাটিও যে আমরা ব্রিটনদের প্রবর্তনা হইতেই পাইয়াছি তাহা খানিক পর্যালোচনা করিলেই ধরা পড়িবে।

২২ জানুয়ারি ২০২০

 

দোহাই

১.            প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য, পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৯৪)।

২.           গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, [সর্বশেষ সংশোধনী সহ মুদ্রিত, এপ্রিল, ২০১৬] (ঢাকা: লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ: আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ২০১৬)।

৩.           Sir Jadu-Nath Sarkar, ‘The End of Muslim Rule,’ in Sir Jadu-Nath Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II (Muslim Period: 1200-1757), reprint (Dacca: University of Dacca, 1976), pp. 481-497.

৪.           Ramananda Chatterjee, ‘Origin and Growth of Journalism Among Indians,’ The Annals of The American Academy of Political and Social Science, vol. 145, Part 2: India (Sept. 1929), pp. 161-168.

সর্বশেষ খবর