চট্টগ্রামে বন্যা দুর্গত মিরসরাই, ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারীতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, হালদা নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙন ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে ওঠায় উপজেলাগুলোর অধিকাংশ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এসব এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। পানিবন্দি এসব মানুষের আকুতি আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর পানির তীব্রতা আরও বেড়েছে। শুক্রবারও এসব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।
মীরসরাই উপজেলার ধুম ইউনিয়নের আনন্দবাজার এলাকায় আটকা পড়েছে মোহাম্মদ ফয়সালের বোনের পরিবার। আশ্রয় পেতে মোবাইল ফোনে একটি নৌকার জন্য বার বার আকুতি জানান পরিচিতজনদের। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে মিরসরাই পৌরসভা থেকে বোনের পরিবারকে উদ্ধার করতে পেরেছে ফয়সাল। কিন্তু নৌকা না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে আনা সম্ভব হচ্ছে না তাদের। এ চিত্র শুধু মীরসরাই উপজেলার নয়, বন্যা কবলিত বেশিরভাগই উপজেলার চিত্র এটি। অনেকে আকুতি জানিয়েছেন বন্যার পানিতে আটকে থাকা পরিবারের লোকজন।
মীরসরাইয়ের গোলকেরহাট এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইলিয়াস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাড়ি-ঘর আসবাবপত্র সবকিছু আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে আসলাম। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। এখন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হবে। গতকাল পানি বেশি ছিল না, তাই বাড়ি থেকে বের হইনি। আজ পুরো ঘর পানিতে ডুবে গেছে, আর থাকতে পারছি না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র চলে আসছি। সবকিছু আল্লার কাছে সপে দিয়ে প্রাণ নিয়ে আসছি’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যাকবলিত অনেক এলাকার লোকজন বৃহস্পতিবার বাড়ি ছেড়ে যায়নি। পরে রাতে পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন। শুক্রবার সকালে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাইলে নৌকা সংকটের কারণে আসতে পারছে না। সন্ধ্যার মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পারলে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে তাদের জীবন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী নদী তীরবর্তী মিরসরাইয়ের চারটি ইউনিয়ন আক্রান্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি করেরহাট ইউনিয়নের জয়পুর পূর্বজোয়ার, পশ্চিম জোয়ার, কাটাগাং, অলিনগর, হাবিলদারবাসা, ছত্ত¡রুয়া, হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর, গনকছড়া, মধ্যম আজমনগর, ধুম ইউনিয়নের শুক্রবার ইয়ারহাট, মোবারকঘোনা, শান্তিরহাট, নাহেরপুর, গোলকেরহাট, মৌলভীবাজার, মিনা বাজার, আনন্দ বাজার এলাকায় শত শত মানুষ আটকা পড়েছেন। রাউজান উপজেলার পশ্চিম নোয়াপাড়া, পালোয়ান পাড়া, মোকামীপাড়া, সাম মাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া, মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা, বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়াসহ কয়েকটি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। হাটহাজারী উপজেলার বন্যায় প্লাবিত এলাকার মধ্যে রয়েছে ফরহাদাবার, মান্দাকীনি, বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী। হালদা নদীর পানি উপচে পড়ে তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর পানিতে ডুবে রয়েছে।
অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কারণে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ছয়দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল এবং ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ওঠায় আরও কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে মীরসরাইয়ে। উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, ধুম ও ইছাখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে এসব এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় উদ্ধার কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এরইমধ্যে এসব এলাকায় মিরসরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণ করছেন।
মিরসরাই উপজেলাও ইউএনও মাহফুজা জেরিন জানান, সবাইকে পানি বেড়ে যাওয়ার আগে নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হলেও অনেকে যায়নি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানি বেড়ে যাওয়ায় এখন নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। আমাদের সাধ্যমতো নৌকা, বোট পাঠানো হচ্ছে। তবে মানুষের তুলনায় নৌকা অপ্রতুল।
ফটিকছড়ির ইউএনও মোজ্জামেল হক চৌধুরী বলেন, সকাল থেকে হালদা নদীর পানি কমতে শুরু করে। এতে ওই এলাকায় বন্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পানি নামছে ধীরে। অনেকেই ত্রাণ ও বোট নিয়ে এসেছেন। তবে বড় বোট নামানো যাচ্ছে না। আবার রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সড়ক পথেও সব এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল