বৃহস্পতিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

কেজরিওয়াল এবং মমতা

তসলিমা নাসরিন

কেজরিওয়াল এবং মমতা

১. বিজেপিকে ধূলিসাৎ করে আম আদমি পার্টির বিরাট বিজয় ঘটেছে দিল্লিতে। বিজেপি ৩, আম আদমি পার্টি ৬৭। এই ক'মাস আগে ভারতের আর সব পার্টিকে হারিয়ে এককভাবে লোকসভা নির্বাচনে জিতেছে বিজেপি। আর এখনই কিনা আম আদমির মতো নতুন একখানা পার্টির কাছে হেরে গেল। অদ্ভুত কথা বটে। এই নির্বাচনে ভারতের সবচেয়ে পুরনো দল, রাজনীতিতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল পেয়েছে ০, হ্যাঁ, শূন্য। এও অদ্ভুত। ভালো লাগুক বা না লাগুক, আমাদের মেনে নিতে হবে জনগণের রায়। আজ বিকেলে বেরিয়েছিলাম শহরে, আম আদমি পার্টির খুব বড় কোনও মিছিল দেখিনি রাস্তায়। বিজেপি কি তৈরি করে রেখেছিল বিশাল কোনও বিজয় মিছিল! সম্ভবত। অনেকে অনেক কারণ দেখাচ্ছে বিজেপি কেন এভাবে গো হারা হারলো। মোদি যা যা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন লোকসভা নির্বাচনের আগে, তার খুব অল্পই তিনি করতে পেরেছেন। আর গণতন্ত্র দিবসে নিজের নাম লেখা দশ লাখ টাকার একটা কোট পরেছিলেন, যেটা বেশ দৃষ্টিকটুই ছিল বৈকি। এই কোটের ব্যাপারটাও মোদির জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিতে সাহায্য করছে। খুব ছোট কিছুও কিন্তু বড় কিছু হয়ে যেতে পারে কখনও কখনও।

ভেবেছিলাম কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তা কমে গেছে যখন গতবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিধানসভা থেকে দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কমারই তো কথা ছিল। অনেক আম আদমি নেতাও তখন দল ত্যাগ করেছিলেন। কেজরিওয়ালের ছেলেমানুষি তাদের পছন্দ হয়নি। ভুল তিনি করেছিলেন। তবে সেই ভুলকে কেজরিওয়াল স্বীকার করেছেন যে ভুল করেছিলেন, এবং সেই ভুলের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন আর করবেন না বলেও কথা দিয়েছেন। লোকের কাছে কেজরিওয়ালের এই স্বীকারোক্তি ভালো লেগেছে। আর এবার বিজেপি বিরোধী দল সব একজোট হয়েছিল বলে, এবং বড় শত্রু বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেসের সমর্থকরাও সম্ভবত ছোট শত্রু আম আদমিকে ভোট দিয়েছে। এসব নানা কারণ কেজরিওয়ালের জিতে যাওয়ার পেছনে।

কেজরিওয়ালকে আমি অভিনন্দন জানিয়েছি খুব চমৎকার একটা কাজ করেছেন বলে। এবারের দিল্লি নির্বাচনের তিন-চার দিন আগে তিনি দিল্লির শাহি ইমাম বুখারির সমর্থন করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন 'ইমামের সমর্থন আমার চাই না'। এই সাহস, ভারতের কোনও রাজনীতিকের নেই। এমনকী হিন্দু মৌলবাদী দলেরও নেই। ভারতের শতকরা পঁচিশ ভাগ মুসলমানের ভোট মুসলিম ধর্মীয় গুরুদের তুষ্ট না করলে পাওয়া যায় না, এই বিশ্বাস প্রতিটি রাজনীতিকের। ভারতের অধিকাংশ মুসলিম এখনও মানসিকভাবে স্বাবলম্বী হয়নি। কাকে ভোট দেবে না দেবে তা তাদের ইমাম বা ধর্মীয় গুরু বলে দেয়। দিল্লির শাহি ইমামকে মুসলিম ভোটের জন্য তোয়াজ করার রীতিটা শুরু করেছিলেন নেহরু। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই। সেই পুরনো রীতি আজও চলছে। শাহি ইমামের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েও কেজরিওয়াল এবার সাধারণ মুসলমানের প্রায় সব ভোট পেয়েছেন। কেজরিওয়ালের জিতে যাওয়া প্রমাণ করেছে, ইমামদের সাহায্য ছাড়াই মুসলিম ভোট জোটে। এখন ভারতের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেওয়া উচিত কেজরিওয়ালের কাছ থেকে। এখন থেকে যেন কোনও ধর্মের কোনও গুরুকেই মাথায় তোলা না হয়। রাজনীতিকরা যেমন ধর্মীয় গুরুকে ব্যবহার করে, ধর্মীয় গুরুরাও রাজনীতিকদের ব্যবহার করে। যে দেশের ধর্ম এবং রাষ্ট্র আলাদা হওয়ার কথা, দুঃখ এই যে, সে দেশে ধর্ম ছাড়া রাজনীতি চলে না, রাজনীতি ছাড়া ধর্ম চলে না। কেজরিওয়ালের দেখানো পথেই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিকরা হাঁটবেন, এই আশা কি খুব বেশি আশা? মৌলবাদী, সে হিন্দু হোক, মুসলিম হোক, খ্রিস্টান হোক, সমাজটাকে পেছনে নেওয়ার জন্য টানাটানি করছে, যতদিন তাদের অস্তিত্ব থাকে, ততদিন করবে। ইমাম, পুরোহিত, পীর, বাবা, মাতা ইত্যাদিকে তোল্লাই দেওয়া মানে সমাজকে ধর্মাচ্ছন্ন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন করার জন্য আরও শক্তি, আরও তেজ, আরও উৎসাহ পেয়ে যাওয়া। এই অশিক্ষিত, নারীবিরোধী অপশক্তি ভারতীয় রাজনীতিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে শিখে গেছে এর মধ্যে। কেজরিওয়াল গতবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভুল করেছিলেন। তিনি তৌকির রাজা খান নামে উত্তরপ্রদেশের এক মুসলিম মৌলবাদীর কাছে গিয়েছিলেন। যাওয়া মানে করুণা চাওয়া। করুণা করে মুসলিম মৌলবাদীটি যেন তাঁর অগুনতি অশিক্ষিত অনুসারীদের বলে দেন এবারের ভোটটা আম আদমিকে দিতে। কেজরিওয়ালের তখন খুব নিন্দা করেছিলাম আমি। ওই তৌকির রাজা খানই সর্বভারতীয় মুসলিম আইন বোর্ডের একজন হয়ে ২০০৫ সালে আমার মাথার মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিলেন। এক কুৎসিত ফতোয়াবাজের কাছে গিয়ে পড়ে থাকাটা ভালো চোখে দেখার কোনও কারণ নেই। আমি জনতাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, এই সেই লোক যে কিনা লোককে বলে, একে ওকে টাকার বিনিময়ে জবাই করতে। কেজরিওয়ালের সমালোচনা হয়েছিল অনেক। সেটি থেকেই বোধহয় কেজরিওয়াল শিক্ষা নিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে তাই মৌলবাদীদের সঙ্গ তিনি ত্যাগ করেছেন। মুশকিল হলো, রাজনীতিকরা সাধারণত শিক্ষা নিতে চান না। যা তাঁদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তার বাইরে তাঁরা মোটেও যেতে রাজি নন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০০৭ সালে সিপিআইএম আমাকে তাড়িয়েছিল মুসলিম ভোটের আশায়, কিন্তু মুসলিম ভোট তারা পায়নি। ও থেকেই রাজনীতিকদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল যে, আমাকে তাড়ালে বা আমাকে হেনস্থা করলে মুসলিম ভোট জোটে না। কেউ শিক্ষা নেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও না। তিনি আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে দিচ্ছেন না, এই ভেবে যে, আমার শত্রুতা না করলে মুসলিম ভোট তিনি হারাবেন। রাজনীতিকদের মস্তিষ্ক থেকে এইসব ভুল বিশ্বাসগুলো দূর করা আর হিমালয় ঠেলে সরানো মনে হয় একই রকম কঠিন। তবে এই কঠিন কাজটি করেই কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন, আসলে যত কঠিন বলে মনে করা হয়, তত কঠিন নয় কাজটি। তিনি ফতোয়াবাজ ধান্দাবাজ ইমামগোষ্ঠীকে সগৌরবে ত্যাগ করে সাধারণ মুসলিমের আস্থা অর্জন করে আজ জিতেছেন। মুসলিমদের জন্য যা দরকার তা হলো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকার, উপার্জনের সংস্থান, জীবনযাপনের মান বাড়ানো। ইমামরা এসব নিয়ে ভাবেন না। ইমামরা ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে সাধারণ মুসলিমদের ডুবিয়ে রাখতে চান।

২. বাংলাদেশ আর লোক পেলো না আমন্ত্রণ জানানোর? শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কবীর সুমন? ওঁরা নাকি একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে শহীদ মিনারে ফুল দেবেন! মমতা দেবেন ফুল ঢাকার শহীদ মিনারে! তিনি তো কলকাতার শহীদ মিনারে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষে প্রগতিশীল ছেলেমেয়েকে কোনও মিছিল করতে দেননি। কিন্তু এক লক্ষ মুসলিম-মৌলবাদীকে শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বাংলাদেশ দূতাবাসের দিকে মিছিল করতে দিয়েছিলেন। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যা করেছেন, তিনি আজ আমন্ত্রিত। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন; ভোটের লোভে, মুসলিম সম্প্রদায়কে ধোঁকা দিয়েছেন, হিন্দু হয়ে, কালীভক্ত হয়ে, কলেমা পড়ে, নামাজ পড়ে, রোজা রেখে, মোনাজাত করে; তিনি আমন্ত্রিত। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী-সাথীরা সারদার চিটফান্ডের অবৈধ টাকা বাংলাদেশের সন্ত্রাসী দল জামায়াতে ইসলামীর দপ্তরে পাচার করেছে; তিনি আমন্ত্রিত। বর্ধমানে মুসলিম সন্ত্রাসীরা বোমা বানাচ্ছিল, দুর্ঘটনা ঘটায় জানাজানি হয়ে যায়। সুমন বলেছেন, মুসলিমরা নয়, বিজেপি বোমা বানাচ্ছিল। মুসলিম সন্ত্রাসী আর মুসলিম মৌলবাদীদের সুমন ডিফেন্ডই শুধু করেন না, সমর্থনও করেন। এই ভয়ঙ্কর লোকটা একুশে ফেব্রুয়ারিতে নাকি শহীদ মিনারে ফুল দেবেন। ফুল দেওয়ার নামে শহীদ মিনারকে কলুষিত করবেন, এই যা। দুটো ভালো গায় বলে তাঁর সাতখুন মাফ হওয়া মোটেও উচিত নয়। গানের কথাগুলো ভালো, কিন্তু, ওসব কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। এখানেই মমতার সঙ্গে তাঁর মেলে। লোক ঠকাতে দুজনেই বেশ ভালো জানেন। গুণী লোকের এতই কি আকাল পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। শেখ হাসিনা ভালো আর যোগ্য কাউকে পেলেন না?

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

 

 

সর্বশেষ খবর