ভাগ্যিস প্রধান উপদেষ্টা, কোনো বিজ্ঞাপনে তার ছবি ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন খুব দ্রুত। না হলে, এতদিনে বাংলাদেশের সংবাদপত্র, টিভি আর অনলাইন মিডিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছবি দিয়ে ছেয়ে যেত। স্তুতি, প্রশংসার এক কদর্য প্রতিযোগিতা শুরু হতো। চলত চাটুকারিতার সর্বনাশা উৎসব। এখান থেকেই শুরু হতো নতুন সরকারের পথ হারানো। কিন্তু একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নতুন উপদেষ্টা। এ সিদ্ধান্তটি আসলে মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এই মানসিকতার বিষয়টি যে কোনো পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গণঅভ্যুত্থানের চার দিন পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে¡ একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের প্রধান কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়। এই সরকারের প্রধান অঙ্গীকার রাষ্ট্র সংস্কার, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত। কোটা সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে পরিণত হয়। এরপরই শুরু হয় গণবিস্ফোরণ। কাজেই অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলিক পার্থক্য আছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশে অতীতে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো গঠিত হয়েছিল, সেই সব সরকারের প্রধান কাজ ছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনীতি শুদ্ধিকরণের চেষ্টা করে। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র সংস্কার আসলে কী? রাষ্ট্র কাঠামোর রূপান্তরের পথটাই বা কী? এখন এ সম্পর্কে নানাজন তাদের মতামত দিচ্ছেন। শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকেও এ সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র যেন নিপীড়নমূলক না হয়, সেটাই রাষ্ট্র সংস্কারের মূল আকাক্সক্ষা। রাষ্ট্র যেন বৈষম্যহীন হয়, সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি। কিন্তু, সেটা কীভাবে করা যেতে পারে? সংবিধান এবং আইন পরিবর্তন নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আমাদের সংবিধান সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যা খুশি তাই করতে পারেন। বর্তমান সংবিধান কাঠামোতে যে কোনো প্রধানমন্ত্রী ‘স্বৈরাচার’ হতে বাধ্য। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা জরুরি। সংবিধানে ‘রাষ্ট্রপতি’ পদটি শুধু ক্ষমতাহীন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ভারসাম্য সুশাসনের জন্য জরুরি। আমাদের সংবিধানে পরপর দুবারের বেশি একই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকতে পারেন না। কিন্তু সরকারের প্রধান নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী যতবার ইচ্ছা দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক বিধিনিষেধ নেই। এখান থেকেই চিরস্থায়ী ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসে। ক্ষমতায় বসে তার মতো সবকিছু সাজিয়ে বারবার ক্ষমতায় থাকার এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন সরকার প্রধানরা। এই ব্যাধি দূর করার জন্য একই ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, তার সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা উচিত। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। জাতীয় সংসদে যারা জনপ্রতিনিধি হন তারা আসলে স্বাধীন নন। তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ করার অধিকার নেই। একটি সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা নেই। একজন সংসদ সদস্য আসলে দলদাস। সংবিধানে এ ধরনের বহু অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। যেসব নিয়ে দীর্ঘদিন কথাবার্তা হচ্ছে। এ জন্য একটি নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি করতে হবে। এ কাজটি কোনো দলীয় সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। পরবর্তীতে তা জনগণের মতামতের জন্য উন্মুক্ত করা দরকার। প্রত্যেক মানুষের মতামত ও পরামর্শকে গুরুত্ব দিতে হবে সংবিধান প্রণয়নে।
রংপুরে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কাঠোমোতে পচন ধরে গেছে।’ বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ও কমিশনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা করে সব দলীয় সরকার। ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন অনুগত ব্যক্তিকেই প্রধান বিচারপতি করা হয়। সরকারি কর্ম কমিশন থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন-সর্বত্র নিজেদের লোক খোঁজা হয়। যোগ্য ব্যক্তি নয়, অনুগত ক্রীতদাসদের বানানো হয় পুলিশ প্রধান, মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মেধা যোগ্যতা নয় বরং চাটুকার অনুগতরাই পদোন্নতি পান তরতর করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা এখন প্রমাণ করে যে, যারা ক্ষমতায় রাষ্ট্রের সবকিছুর মালিক তারাই। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পদোন্নতি, আইন-বিচার, পুলিশ, শিক্ষাঙ্গন সবকিছু কুক্ষিগত করে ক্ষমতাসীন দল। যারা ক্ষমতাসীন দলের ছায়াতলে থাকে তারাই হালুয়া-রুটির ভাগ পায়। যারা বিরোধী দলে তাদের কপালে জোটে শুধু বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন। ক্ষমতাচ্যুত হলে সবকিছু হারাতে হবে, এই আতঙ্ক থেকে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করাই হয় শাসক দলের একমাত্র লক্ষ্য। এ জন্য তারা চাটুকারদের চারপাশে ভেড়ায়। বিশ্বস্ত মোসাহেব খোঁজে সর্বত্র। ফলে দ্রুতই তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তারা হয় গণবিরোধী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুশাসন, জবাবদিহিতা। গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় নাগরিকদের কাছে। মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি হারায় রাষ্ট্র। এ অবস্থার অবসান দরকার। সরকারি কর্মকমিশন, নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তাই ঢেলে সাজাতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, আইন এমনভাবে করতে হবে যাতে চাইলেই পছন্দের ব্যক্তিকে পদে বসিয়ে দেওয়া না যায়। এসব প্রতিষ্ঠান যেন নিপীড়নের হাতিয়ার না হয়। একটি সরকারকে ক্ষমতায় রাখার কাজে যেন এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত না হয়। সে জন্য আইন পরিবর্তন জরুরি। বাংলাদেশে এরকম বহু যোগ্য ব্যক্তি আছেন যারা এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারেন।
সংবিধান, আইন পরিবর্তন করে একটি বৈষম্য মুক্ত রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে নতুন সরকারকে। এটি চটজলদি কোনো কাজ নয়। আইন নীতি পরিবর্তন করতে হবে নির্মোহভাবে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, শুধু সংবিধান এবং আইন পরিবর্তন করেই কি রাষ্ট্র সংস্কার করা যাবে? সব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন করলেই কি এই রাষ্ট্র জনবান্ধব হবে? আমার তা মনে হয় না। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের মনোজগতের সংস্কার। আমি নির্যাতিত হয়েছি তাই এবার প্রতিপক্ষকে দ্বিগুণ শাস্তি দেব কিংবা আমার চিন্তার সঙ্গে তুমি একমত নও-তাই তুমি রাষ্ট্রের শক্র -এরকম তীব্র প্রতিহিংসার মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন সম্ভব নয়। আজকে এই সরকার হয়তো সংবিধান সংশোধন করল, আইন পরিবর্তন করল, যোগ্য ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিল, কাল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে সংখ্যারিষ্ঠতার জোরে এক নিমিষে সংবিধান পাল্টে দিতে পারে। আইন বাতিল করতে পারে। যোগ্য ব্যক্তিকে হটিয়ে নতুন করে পছন্দের ব্যক্তিদের আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বসিয়ে দিতে পারে। তাই মানসিকতার পরিবর্তন হলো সবচেয়ে জরুরি কাজ। আমার কাছে ভালো লেগেছে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। হিংসা নয়, জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার এই আকাক্সক্ষা মাঠে অনূদিত হতে হবে। যারা নির্যাতন, গুম খুনের সঙ্গে জড়িত, যারা লুণ্ঠন করেছে, অর্থ পাচারকারী, নির্যাতনকারী তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ভিন্ন মতের- এই অভিযোগে কাউকে নিগৃহীত করা যাবে না। এটা করা হলে এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। আবার আমরা বিভক্তির কাটাকুটি খেলায় সব অর্জন বিসর্জন দেব। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু প্রতিহিংসার বীভৎসতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বীর শ্রেষ্ঠদের ম্যুরাল ভেঙে ফেলা, ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভবনে পৈশাচিক তান্ডব, জলের গানের রাহুলের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া কোনো সুস্থ মানসিকতার কাজ নয়। ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা এসব উন্মত্ততা এক্ষুনি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও লক্ষ্য করছি কিছু প্রতিহিংসা বিভক্তির নোংরা খেলা এখনো চলছে। ১০ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি চিঠি আমার কাছে পাঠায় একজন অনুজ। প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের কাছে লেখা এই চিঠিতে ৫১ জনের নাম রয়েছে। এই ৫১ জনের কর্মকান্ডকে ‘জাতীয় এবং রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের প্রেস ক্লাব থেকে বহিষ্কার এবং সাংবাদিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হয়েছে ওই চিঠিতে। যে সব শিক্ষার্থী এই তালিকা প্রণয়ন করেছেন, তারা কি জেনে বুঝে করেছেন নাকি কেউ তাদের এই তালিকা প্রণয়নে প্ররোচিত করেছে? এ প্রসঙ্গে পতিত সরকারের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ল। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনার সরকার শেষ দিকে গণগ্রেপ্তার শুরু করেছিল। সেই গণগ্রেপ্তারে গ্রেপ্তারি পরোয়ান জারি করা হয়েছিল প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধেও। অনুগত পুলিশ বাহিনীর একটি অতি উৎসাহী দল প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে খুঁজতে তার বাড়ি পর্যন্ত হানা দিয়েছিল। এ ঘটনাটির কথা লিখলাম এই তালিকায় আমার নিজের নাম দেখে। যারা এই তালিকা করেছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি; আমি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য না। নীতিগত অবস্থানের কারণে আমি এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোনো দিনই অনুভব করিনি। শুধু প্রেস ক্লাব না, সাংবাদিকদের কোনো ধরনের ইউনিয়ন বা রিপোর্টার্স ইউনিটিরও আমি সদস্য না। আমাকে প্রেস ক্লাব থেকে বহিষ্কার করবে কীভাবে? তালিকাটি প্রণয়নের আগে একটু যাচাই-বাছাই করলে ভালো হতো না? এ বিষয়ে আমি আরেকটু ব্যক্তিগত কৈফিয়ত দিতে চাই। শেখ হাসিনা মোট ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই ২০ বছরে আমি একবারও প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হইনি, নীতিগত অবস্থানের কারণে। কোনো সরকারের আমলে আমি কোনো প্লট, টেলিভিশনের লাইসেন্স, ব্যাংক ঋণ কিংবা কোনো পুরস্কার নেইনি। যারা এই চিঠি লিখেছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে আমি এটাও জানাচ্ছি, ঢাকা শহরে আমার কোনো ফ্ল্যাট, জমি নেই। হ্যাঁ, আমার একটি নিজস্ব বিশ্বাস আছে। একটি আদর্শকে আমি লালন করি। একটি মতামর্শকে আমি পছন্দ করি। আমি টকশো করি না, স্বাধীন লেখালেখি করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় জেন-জি যেমন একটি পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক তেমনি আমরাও ’৯০-এর স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের গর্বিত যোদ্ধা। ’৯০-এর গণআন্দোলনের অনেক সহযোদ্ধা এবার উপদেষ্টামন্ডলীতে, যাদের অনেকের সঙ্গেই আমার প্রচন্ড সখ্য, আত্মার সম্পর্ক। যদিও লেখায় ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উল্লেখ করার আমি ঘোর বিরোধী। তবুও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ১৯৮৮ সালের ২১ আগস্ট আমার ছেলের জন্ম হয়। সেদিন আমার পকেটে ছিল এক শ পঞ্চাশ টাকা। আসিফ নজরুল (নজরুল ভাই) খবর পেয়ে পিজি হাসপাতালে ছুটে আসেন। সঙ্গে মঈনুল কবীর ভাই (সাবেক লেজিসলেটিভ সচিব) এবং হুমায়ুন ভাই। ওরা সবাই আইন বিভাগে আমার এক ব্যাচ সিনিয়র।
আমার কাছে টাকা নেই শুনে নজরুল ভাই দুজনকে হাসপাতালে রেখে আমাকে নিয়ে গেলেন তার লালবাগের বাসায়। নিজের মাটির ব্যাংকটি ভাঙলেন। দুজনে মিলে টাকা গুনলাম। এক হাজার সাত শ টাকা হয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে ডেলিভারি হলো। আমাদের সম্পর্কটা এমনই। ভাই এবং বন্ধুর। আমাদের মধ্যে চিন্তার দুস্তর ফারাক। আমরা মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক করি, কাউকে খতম করি না। এই মানসিকতাটাই হলো রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের মূল। কথায় কথায় কাউকে ‘দালাল’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া এই আন্দোলনের চেতনা নয়। কাউকে মানবতাবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী বলার আগে যাচাই-বাছাই করা উচিত। না হলে এক স্বৈরাচার বিদায় করে আমরা নতুন স্বৈরাচারের জন্ম দেব। এক দানবের মৃত্যুর পর নতুন দানব তৈরি হবে। শুধু সাংবাদিকদের তালিকা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত ক্ষোভ আক্রোশ, প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি সিন্ডিকেট বিদায় করে নতুন সিন্ডিকেট যেন সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। না হলে এই বিজয়ের সুফল জনগণ পাবে না। দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, সুবিধাভোগী আর ভিন্ন মতাবলম্বী এক পাল্লায় উঠানো যাবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তা প্রকাশের সুযোগ বন্ধ করলে আমরা আবার অন্ধকার পথে হাঁটতে শুরু করব। এজন্য প্রয়োজন মনোজগতের পরিবর্তন। কেবল বাইরের ক্ষত সারলেই চলবে না, আমাদের মানসিকতায় ভুল কিছু বিশ্বাস বাসা বেঁধেছে। এই ভ্রান্তির শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। আগে একজন দুর্নীতিবাজকে সামাজিকভাবে ঘৃণা করা হতো। এখন তাকে সমীহ করা হয়। আগে একজন স্ত্রী বা সন্তান পিতার অস্বাভাবিক বৈত্ত-বৈভবে উদ্বিগ্ন হতেন। এখন খুশি হন। সমাজের একটি অংশের মধ্যে শর্টকাট বড়লোক হওয়ার উদগ্র বাসনা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত হলেই ব্যবসা পাওয়া যাবে, টেন্ডার ভাগানো সহজ হবে, অবাধে ব্যাংক লুট করা যাবে, আইন-বিচারকে দেখানো যায় বৃদ্ধাঙ্গুলি এরকম একটি নষ্ট মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের সর্বত্র। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই সম্ভব রাষ্ট্রের সংস্কার। কাজটা সহজ নয়, অনেক কঠিন। তবে আমি আশাবাদী। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই এই মানসিকতা পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। শুধু কথায় নয়, কাজ দিয়ে তারা পরিবর্তনের পথ দেখাচ্ছেন। গত শনিবার (১০ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টা শহীদ আবু সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রংপুরে যান। সেখানে সার্কিট হাউসের আলোচনায় তার জন্য রাখা হয়েছিল সিংহাসন আকৃতির চেয়ার। অতীত অভ্যাস আর অভিজ্ঞতা থেকেই এরকম ব্যবস্থা করেছিলেন আয়োজকরা। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই চেয়ারটি সরিয়ে দিলেন। সাধারণ চেয়ারটি প্রায় নিজেই টেনে নিলেন আশি ঊর্ধ্ব এই মানুষটি। এটাই মানসিকতা। সাদামাটা চোখে বিষয়টি ছোট। কিন্তু এর তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকার প্রধান নক্ষত্রের দূরত্বে থাকা কোনো দেবদূত নন। সাধারণ একজন মানুষ। এই বার্তাটি প্রশাসনকে দেওয়া জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চাইলেই আবু সাঈদের পরিবারকে ঢাকায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে তাদের অ্যাপায়িত করলেও কেউ কিন্তু বলত না। কিন্তু তিনি তা করেননি। ছুটে গেলেন রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে। খোলা আকাশের নিচে, অনাড়ম্বরভাবে একটা ভাঙা চেয়ারে বসে তিনি মিশে গেছেন গ্রামবাসীর সঙ্গে। সবার কাছে বিষয়গুলো নতুন। প্রশাসন, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের চারপাশে থাকা মানুষগুলোর কাছে এসব অপরিচিত আচরণ। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই মনোজাগতিক পরিবর্তন ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। প্রধান উপদেষ্টার পথ ধরে দেখলাম আইন উপদেষ্টা শনিবার দপ্তরে গেছেন সাদামাটাভাবে। একজন উপদেষ্টাকে ফুলহীন বরণ আমাদের প্রচলিত ভাবনায় প্রচন্ড আঘাত। এভাবে রাষ্ট্র সংস্কারে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। এই যুদ্ধে জয়টা জরুরি।
আমরা জানি, একটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, অর্থনীতি গতিহারা। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষতচিহ্ন। গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অভাব সর্বত্র। এসব চ্যালেঞ্জ কঠিন। মনে রাখতে হবে নতুন সরকারের কাছে কোনো জাদুর কাঠি নেই। ভোজবাজির মতো রাতারাতি সব পাল্টে ফেলা অসম্ভব। বাঙালি জাতি প্রচন্ড আবেগ প্রবণ। তীব্র ভালোবাসায় একজন মানুষকে সহজেই দেবদূত বানিয়ে দিই আমরা। আবার তাকে ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে ফেলতেও সময় নিই না। জোয়ার-ভাটার মতো আমাদের মন। সকালে ভালোবাসার খরস্রোত বিকালে শুকিয়ে যায়। শেখ হাসিনাকে হটিয়ে এদেশের মানুষের প্রত্যাশার পারদ এখন অনেক ওপরে। মানুষ চটজলদি দৃশ্যমান প্রাপ্তিযোগ চাইবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে। নতুন নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দেবে। কদিন পরই শুরু হবে নানামুখী চাপ। বিভিন্ন ধরনের দাবি-দাওয়ার ফিরিস্তি লম্বা হতে থাকবে। এই ধারায় যদি আমরা যাই তা হলে না হবে রাষ্ট্র সংস্কার, না হবে পরিবর্তন। আমাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। অস্থিরতা তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। চাপ নয়, সময় দিতে হবে নতুন সরকারকে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল : [email protected]