অভিধান প্রকাশনার জন্য বিশ্বখ্যাত ও প্রায় ২০০ বছরের পুরনো মার্কিন প্রকাশনা সংস্থা মারিয়ম ওয়েবস্টার তাদের অনলাইন অভিধানে ‘বিপ্লব’ (রেভল্যুশন) ও বিদ্রোহ (রিভোল্ট) শব্দ দুটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘রিভলভেরি’ থেকে হয়েছে বলে দাবি করে। ল্যাটিন শব্দ রিভলভেরির অর্থ ‘ফিরে আসা’, ‘ঘুরে আসা’ ইত্যাদি। ১৪ শতকে এমন শব্দ দিয়ে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র কোনো কারণে নিজ কক্ষপথ বা গতিপথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর পুনরায় নিজের কক্ষপথে ফিরে আসা বা একটা আবর্তন শেষে ঠিক গতিপথে ঘুরে আসা অর্থে ব্যবহৃত হতো। কাকতালীয় হলেও সত্য, প্রায় একই সময়ে ইউরোপে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়, যা তখনকার কৃষক বা প্রজাবিরোধী সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে পাল্টে দিয়েছিল। সেই থেকে রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে আছে ‘বিপ্লব’ ও ‘বিদ্রোহ’ নামের দুটি শব্দ।
১৪ শতকের শেষ দিককার কথা। ১৩৮১ সালের ৩০ মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসজুড়ে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এক ভয়াবহ কৃষক বিদ্রোহ। ১৩৭৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড মৃত্যুবরণ করেন। রাজা হওয়ার মতো উপযুক্ত কেউ বেঁচে না থাকায় এডওয়ার্ডের পৌত্র বা ছেলের ঘরের নাতি দ্বিতীয় রিচার্ড তখন সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ সময় রিচার্ডের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। ইংল্যান্ডের সমাজব্যবস্থায় তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্ষমতার বলয়ে ঢোকার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই ১০ বছরের এক বালককে কেবল নীলরক্তের কারণে ক্ষমতায় বসতে হয় এবং ইংল্যান্ডবাসীকে তা নীরবে মেনে নিতে হয়। এর প্রতিক্রিয়া ছিল দুই ধরনের। একদল এমন বংশতন্ত্রের কারণে ক্ষুব্ধ হয়, আর অন্য দল অর্থাৎ সুযোগসন্ধানীরা বালক রাজাকে পুতুল বানিয়ে সামনে রেখে নিজেদের ইচ্ছামতো ভোগ, বিলাস ও সম্পদের পাহাড় গড়া নিয়ে মত্ত হয়ে থাকে।
১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ পর্যন্ত সাত বছর ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘বিউবনিক প্লেগ’ নামক এক ধরনের মাছিবাহিত মহামারি। সেই আমলেই আড়াই থেকে ৫ কোটি মানুষ এই মহামারিতে প্রাণ হারায় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এমন মহামারির পর স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েছিল ইংল্যান্ডের আর্থসামাজিক অবস্থা।
১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত প্রায় ১১৬ বছর যুদ্ধ করেছে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। ‘হানড্রেড ইয়ার্স ওয়ার’ বা শতবর্ষী এই যুদ্ধে ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়তে হয় অনেককে। আর আপামর জনতা নানাভাবে যুদ্ধজনিত নানা উপসর্গের শিকার হয়। যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন খাতে অর্থ আদায় শুরু হয় সাধারণ জনগণের কাছ থেকে। এর ফলে নানাভাবে জনজীবনে দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে। যুদ্ধের খরচ বেড়ে গেলে উচ্চহারে খাজনা আদায় শুরু করেন রাজ-কর্মচারীরা। সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন খাজনার ভার বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন একটি খাজনার নাম ছিল ‘পোল ট্যাক্স’, যার অপর নাম ‘মাথাপিছু খাজনা’। অর্থাৎ যে যতই উপার্জন করুক না কেন মাথাপিছু একটা অঙ্কের খাজনা তাকে অবশ্যই দিতে হবে।
১৩৮১ সালের ৩০ মে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত এসেক্স অঞ্চলের ব্রেন্টউড নামক স্থানে এই মাথাপিছু খাজনা আদায় করছিলেন রাজ-কর্মচারীরা। এ সময় বকেয়া খাজনা নিয়ে সাধারণ জনগণ ও রাজ-কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ বাধে। ক্রমেই সেই বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। একে একে বিরোধে শামিল হন গ্রামের সাধারণ কৃষক, বিভিন্ন পেশার শ্রমিক-কারিগরসহ সর্বস্তরের মানুষ। সে সময় ‘সার্ফডম’ নামক এক ধরনের ঘৃণ্য প্রথা চালু ছিল। এ প্রথা অনুসারে কৃষকরা কোনো কারণে ধনীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সময়মতো সেই ঋণ সুদ-আসলে ফেরত দিতে না পারলে ক্রীতদাসের মতো সারাজীবনের জন্য দায়বদ্ধ হয়ে পড়ত মহাজন বা ঋণদাতার কাছে। ১৩৮১ সালের সেই বিপ্লবে এমন হাজার হাজার কৃষকও যোগ দিয়েছিল।
এমন বিপ্লবের নেপথ্যে একটি বড় শক্তি ছিল ইংল্যান্ডেরই জন বেল নামক এক ধর্মযাজকের ফতোয়া বা ধর্মোপদেশ। যে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজার তথা অভিজাত শ্রেণির সব কাজের বৈধতা দিতেন, তিনি বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে ফতোয়া দিতেন। বিপ্লবের আরেক প্রাণপুরুষ ছিলেন ওয়াল্টার ওয়ার্ড টেইলর। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কেন্ট অঞ্চল থেকে হাজার হাজার বিপ্লবী জনতা নিয়ে তিনি রাজধানী লন্ডনের দিকে এগিয়ে আসেন। লন্ডনের তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা মেয়র এবং তার অনুগত বাহিনী ক্রমান্বয়ে টেইলরের ওপর চড়াও হতে থাকে। অদম্য সাহসী টেইলর মোটেও পিছু না হটে বীরের মতো মোকাবিলা করেন মেয়র ও তার পেটুয়া বাহিনীকে। এমন চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে ১৩৮১ সালের ১৬ জুন; অর্থাৎ বিপ্লব শুরুর ১৬ দিনের মাথায় রাজা এবং মেয়রের পক্ষে থাকা এক অফিসারের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান টেইলর। এতে বিপ্লবীরা সাময়িকভাবে ছত্রভঙ্গ হয়। এ সুযোগে মেয়রের অতি উৎসাহী সমর্থকরা টেইলরের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে লন্ডন ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখে। এরপর বিপ্লবীরা মরণকামড় বসায় মেয়রের পেটুয়া বাহিনী ও রাজার সরকারি বাহিনীর ওপর। এই বিপ্লবে ইংল্যান্ড ও আশপাশের এলাকার জেল ও গোপন টর্চার সেল ভেঙে বিনা বিচারে বা প্রহসনের বিচারে বন্দি ও দীর্ঘদিন ধরে গুম হয়ে থাকা শত সহস্র সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করে কৃষকরা। এরপর তারা ধ্বংস করে শাসন ও শোষণের মূর্তপ্রতীক সেভয় প্রাসাদ। যে কালো আইনের দ্বারা কৃষকদের পদে পদে আটকানো হতো ও সাজা দেওয়া হতো, এমন সব আইনের বই পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর যেসব ধর্মশালায় বসে সব বকধার্মিক রাজা ও রাজ-কর্মচারীদের সব কৃতকর্মকে বৈধতা দিত, সেসব ধর্মশালাও পুড়িয়ে ফেলা হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়লে সেখানে হত্যা করা হয় রাজার অন্ধ চাটুকার ‘অফিসার’ নামক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের। হত্যাকান্ডের শিকার অন্যদের মধ্যে ছিলেন সর্বোচ্চ সম্মান বা প্রধানমন্ত্রীতুল্য একজন মন্ত্রী, আর্থিক সংস্থার প্রধান বা ‘লর্ড হাই ট্রেজারার’ (কেন্দ্রীয় ব্যাংকার গভর্নরতুল্য) পদে থাকা কর্মকর্তা স্যার রবার্ট হেইলস প্রমুখ। এই বিপ্লব সামাল দেওয়ার জন্য ১৪ বছর বয়সি রাজা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন এবং ‘সার্ফডম’ তথা ঋণের কারণে শর্তের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া তথা দাসপ্রথার এই প্রবণতা বাতিলসহ প্রায় সব দাবিদাওয়া মেনে নেন। তবে তত দিনে আনুমানিক ১৫০০ কৃষকের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল লন্ডনের টেমস নদীর পানি। ১৩৮১ থেকে ২০২৪- এই ৬৪৩ বছর পর সেই কৃষক বিপ্লবের ইতিহাস পড়তে গিয়ে মনে পড়ল অনেক কিছু। এই যুগেও রাজ-পরিবারের মতো যেন নীলরক্ত ছিল কিছু পরিবারের মানুষের শরীরে। ১৪ বছরে রাজ-পরিবার কোটায় রাজা হওয়ার মতো তারাই কেবল সরকারি চাকরি, ব্যাংক ঋণ, ঠিকাদারি, আমদানি-রপ্তানি সনদ, ব্যাংকের ঋণ, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা- সবই পেত।
‘বিউবনিক প্লেগ’-এর মতো করোনা মহামারির কথা আর ইংল্যান্ড-ফ্রান্স যুদ্ধের মতো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কথাও চোখে ভাসে। ইদানীং যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে পূর্বতন সরকারি আমলা, সেনা, নৌ ও পুলিশ অফিসার, রাজনীতিবিদ ও সরকারের তল্পিবাহকদের সম্পদের পাহাড়ের কথা সামনে আসে, তখন বারবার মনে পড়ে সেই অভিজাত শ্রেণির কথা। ১৩৮১ সালে যারা ১৪ বছরের বালক রাজাকে সামনে রেখে নিজেদের ইচ্ছামতো ভোগ-বিলাস ও সম্পদের পাহাড় গড়েছিল। পোল ট্যাক্স বা মাথাপিছু খাজনা হয়তো আমরা দিইনি, কিন্তু ভাবা যায় ১৬ বছরে এক ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৬ বার! বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, জ্বালানি তেলের দাম, চিনির দাম, ভোজ্য তেলের দাম, আলু-পিঁয়াজের দাম- সব কী হারে বেড়েছে, কেন বেড়েছে, কোথায় গিয়ে এই দাম ঠেকবে কেউ জানত না।
কোনো দাসপ্রথা আমাদের হয়তো ছিল না। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো এমনকি মেয়েদের ছাত্রীনিবাসের গণরুম, রেগিং ও অন্যান্য বর্বরতার কথা কিছুটা হলেও প্রকাশ পেত, তখন মনে হয় সেই ১৩৮১ সালের ‘সার্ফডম’ বা দাসপ্রথার কথা। ইংল্যান্ডের বিপ্লবের নেপথ্যে ছিলেন ধর্মযাজক জন বেল, যার ফতোয়া বিপ্লবীদের উজ্জীবিত করত। আর এই যুগে একদল সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা বিস্তারের মতো বিদেশের মাটিতে বসে ক্রমাগতই প্রচার করে গেছেন সরকারের এবং তার সুবিধাভোগীদের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্বিচারের সব উপাখ্যান। আলেম সমাজের ইউটিউবভিত্তিক বয়ানও মাঠে নামিয়েছে অনেককে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ১৩৮১ সালের কৃষক বিপ্লবের ১৬ দিনের মাথায় হত্যা করা হয়েছিল বিপ্লবের প্রবাদপুরুষ ওয়ালটন ওয়াট টেইলরকে, যার মৃত্যু মরণপণ একতায় আবদ্ধ করেছিল সমস্ত বিপ্লবীকে। ২০২৪-তে এসে ১ জুলাই শুরু হওয়া সাম্প্রতিক বিপ্লবের ১৬তম দিনেই অর্থাৎ ১৬ জুলাই সেই ওয়ালটন ওয়াট টেইলর যেন আবু সাঈদ হয়ে আবারও আবির্ভূত হয়েছিলেন রংপুরের মাটিতে। তার মৃত্যুও একইভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল সমস্ত জাতিকে।
ইংল্যান্ডের বিপ্লবের পর যেভাবে বন্দিদের উদ্ধার করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে উদ্ধার করা হয় তথাকথিত আয়নাঘরে আটকে পড়া মানুষকে। জনতার আক্রোশের সবটুকু যেন বানের পানির মতো ঢুকেছিল সেই সেভয় প্রাসাদতুল্য গণভবনে। আইনের বই না পুড়লেও মানুষ আশাবাদী- অচিরেই তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নানা ক্ষেত্রে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালা-কানুন এবার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। একে একে বিদায় নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন প্রধান বিচারকসহ অনেক বিচারক, গভর্নর, উপাচার্য, মন্ত্রীসহ আগের আমলের ভীতু, কাপুরুষ, লোভী, স্বার্থপর, নির্লজ্জ সব অভিজাত শ্রেণির অমানুষেরা।
তাই বড় একটি স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের মতো, রাজধানী লন্ডনের মতো আর দেশটা ইংল্যান্ডের মতো। তরুণদের অদম্য কর্মযজ্ঞই এই স্বপ্ন দেখায়।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]