কোনো ইবাদতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কোনো কিছুর প্রার্থনা করলে প্রার্থনাকারীর অন্তরে সাধারণ দুটি জিনিস থাকে। যথা- ভয় ও অহংকার। পক্ষান্তরে মাধ্যম ছাড়া প্রার্থনায় এগুলো থাকে না। সরাসরি আল্লাহর কাছে চাওয়ার দ্বারা আবদিয়াত বেশি প্রকাশ পায়। এ জন্যই প্রত্যেক ইবাদত ও আমলের সঙ্গে দোয়া রাখা হয়েছে, যাতে আমল করার পর দোয়া করা হয়। ইবাদত ও আমল করলে মাধ্যম ব্যবহার করে আবদিয়াত প্রকাশ করা হলো, পক্ষান্তরে দোয়ার মধ্যে সরাসরি আবদিয়াত প্রকাশ পায়। আবদিয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহর সামনে নিজেকে অপদস্থ মনে করা, মিটিয়ে দেওয়া, মেথর ও চামারের চেয়েও নিজেকে ছোট মনে করা। আর এই অবস্থাটা দোয়ার মাধ্যমে বেশি প্রকাশ পায়। শুধু বেশি বেশি ইবাদত করলে দিলের মধ্যে আমিত্বভাব সৃষ্টি হতে পারে, কোরআন শরিফ সুন্দর করে পড়তে পারলে অন্তরে অন্য রকম একটি ভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু দোয়ার মধ্যে এরূপ হয় না, দোয়ার মধ্যে কাঁদতে হয় রোনাজারি করতে হয়। সবাই বুঝতে পারে যে, এত বড় হুজুরও কাঁদে। মোট কথা দোয়ার মধ্যে বিনয় সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায়। সমস্ত ইবাদতের আত্মা হলো দোয়া। এ জন্য এমন কোনো ইবাদত নেই যার মধ্যে দোয়া নেই। ওই ইবাদত ইবাদতই নয় যার মধ্যে দোয়া নেই। নামাজ, রোজা ইত্যাদি সব ইবাদতের মধ্যে দোয়া আছে।
আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন জাগতিক প্রয়োজন সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রয়োজন পূরণার্থে মানব জীবনকে অসংখ্য নেয়ামত দ্বারা আচ্ছাদিত করেছেন। তন্মধ্যে বিশেষ নেয়ামত হলো, রাত-দিনের সৃষ্টি।
“আল্লাহ রাত সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আরাম করতে পারো।” ঘুম হলো আরামের বস্তু। আল্লাহপাক তা এমনভাবে রাতে দিয়েছেন যে, গভীর অন্ধকারে সবার একত্রে নিদ্রা চলে আসে। যাতে একজন অপর জনকে বিরক্ত না করে। আলো থাকলে ঘুম আসে না বিধায় তিনি রাতকে অন্ধকার বানিয়েছেন। তবে আরাম দুই প্রকার (১) যাহেরি (২) বাতেনি। শারীরিক আরাম হলো যাহেরি তথা বাহ্যিক আরাম আর আত্মিক আরাম হলো বাতেনি তথা অন্তরের আরাম। যারা ঘুমাতে যায় তাদের সবার রাতে ঘুম আসে। তারা শরীরের আরাম উপভোগ করে। আর যারা আত্মা ও দেমাগের আরাম খোঁজে তাদের কারও শেষ রজনীতে ঘুম আসে না। তখন তারা জাগ্রত অবস্থায় ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে দিলের শান্তি ও আরাম উপভোগ করে।
সাহাবিদের রাতের অবস্থা জানার জন্য একদিন শেষ রাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে বের হলেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণা ছিল যে, শেষ রাত দোয়া কবুলের সময়, ইবাদতের সময়, এ সময়ে অন্তত আবু বকর তো ঘুমাবে না। তিনি হজরত আবু বকর (রা.) এর ঘরের কাছে গিয়ে হাজির হলেন, কিন্তু কোনো তেলাওয়াত, যিকির ও দোয়ার সাড়া শব্দ না পেয়ে মনে খুব ব্যথা অনুভব করছেন। অতঃপর এক-পা দু-পা এগিয়ে যখন ঘরের বেড়ায় কান লাগালেন তখন গোঁঙানো আওয়াজ শুনতে পেলেন। হজরত আবু বকর (রা.) ওই সময় কাঁদছিলেন। ...রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণা সঠিক হলো। তিনি খুব খুশি হলেন।
আমরা রাতে শব্দ করি তবে আমাদের সেই শব্দ হলো ঘুমের, ক্রন্দনের নয়। আল্লাহওয়ালা হতে চাইলে হজরত আবু বকর (রা.)-এর মতো শেষ রাতে উঠে কাঁদতে হবে। চোখের পানি ফেলতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। যে ব্যক্তি শেষ রজনীতে উঠে নামাজ পড়বে, কোরআন শরিফ তারতীলের সঙ্গে তেলাওয়াত করবে আল্লাহপাক তার দিল পাক করে ইলম ও মারেফাত প্রবেশ করাবেন। এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, শেষ রাতে জাগ্রত হওয়া ছাড়া কোনো উস্তাদ বা ছাত্র আল্লাহওয়ালা হতে পারবে না। রাতের পরের নেয়ামত হলো আমি দিনকে আলোকিত করে বানিয়েছি যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করতে পার, রাস্তাঘাটে যাতায়াত করতে পার, কাজ করতে পার।
দিন আল্লাহ পাকের এক নেয়ামত। সারা দুনিয়ার সব লাইট একত্রিত করেও দিনের মতো স্পষ্ট সুন্দর ও উজ্জ্বল আলো সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। দিনের আলোতে কাজ করে যে শান্তি, রাতে লাইটের আলোতে কাজ করলে সে শান্তি আদৌ পাওয়া যায় না। তাই তো তিনি বলেছেন, “আল্লাহ পাক বান্দার ওপর অনুগ্রহশীল। যদি তাই না হতো তাহলে চোখ দিয়ে আল্লাহর নাফরমানি করার পর সে চোখ আর সুস্থ থাকত না। আমাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরা কোনো আবেদন ছাড়াই তিনি দান করেছেন, অতঃপর সেই অঙ্গ দ্বারা নাফরমানি করলেও তিনি সেগুলো কেড়ে নেন না। তার চেয়ে বড় দয়ালু আর কে আছে!
দুনিয়াতে ছাদ না থাকলে আমরা বাতি, পাখা ইত্যাদি লাগাতে পারি না। আল্লাহ পাকও আসমানকে ছাদ বানিয়ে তাতে সূর্য, চন্দ্র, তারকা, গ্রহ-উপগ্রহ দিয়েছেন। তিনি মানুষের আরামের জন্য বরফকে ওপরে রেখেছেন। যখন প্রয়োজন হয় তখন তিনি বাতাসের মাধ্যমে সারা দুনিয়া শীতল করে দেন। এরপরও যদি শীতল না হয় তখন তিনি তা বাতাসের মাধ্যমে দুনিয়াতে ছেড়ে দেন। বরফগুলো বিশাল আকারের বিধায় তিনি বাতাসের সাহায্যে পাহাড়ে ছাড়েন। যদি তা টুকরা টুকরা করে ফেলতেন তাহলে দুনিয়ার মানুষের জন্য সমস্যার কারণ হতো।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ