দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, নো দাইসেলফ। নিজেকে চেনো। হাদিসে আছে- ‘মান আরাফা নাফছাহু, ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’। অর্থাৎ নিজেকে চিনতে পারলে আল্লাহকে চেনা যাবে। নিজেকে চেনার জন্য কতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন। ধরুন, আমি দেশ চালাচ্ছি। দেশ চালানোর জন্য কতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন। নিজেকে চেনার জন্য বা দেশ চালানোর জন্য যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন ততটুকু জ্ঞান কি আমার আছে? এটা কি বলা যাবে? এটা অত্যন্ত অপ্রিয় সত্য যে, শুধু আমার না, পৃথিবীর ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান পশুপাখির জ্ঞানের চেয়ে বেশি নয়। এমন কথায় অনেকে বিস্মিত হবেন, অনেকে ক্ষুব্ধ। বলবেন, আমি তো ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছি, আমার জ্ঞানও কি পশুপাখির জ্ঞানের চেয়ে কম। দর্শন কিন্তু তাই বলছে। এর ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যা দিলে বোঝা যাবে, আমাদের জ্ঞানের মাত্রা কতটুকু। জ্ঞানের ছয়টি স্তর বা মাত্রা। যেমন- অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, অতি সাধারণ জ্ঞান- এ দুটো সহজাত। সাধারণ জ্ঞান এবং বুদ্ধি- এ দুটো অভিজ্ঞতালব্ধ। অলৌকিক জ্ঞান এবং দর্শন- এ দুটো আধ্যাত্মিক তিনটি নেচারের ছয়টি মাত্রা। ছয়টি মাত্রার ওপর ভিত্তি করে সব প্রাণীকে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কারও মধ্যে একটি, কারও মধ্যে দুটি, কারও মধ্যে তিনটি, ঠিক এভাবে। একটি মাত্রা কোন প্রাণীর? স্যার জগদীশচন্দ্র বসু বলেছেন, গাছের প্রাণ আছে, আমি বলেছি যার প্রাণ আছে, তার জ্ঞান আছে। যার জ্ঞান আছে তার প্রাণ আছে। সে হিসাবে গাছের জ্ঞান আছে। যার জ্ঞান আছে তার অনুভূতি আছে। যার অনুভূতি আছে তার ব্যথা আছে। গাছের ব্যথা আছে। এ জ্ঞান সব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে। দুটো মাত্রা কেঁচোর মধ্যে। তিনটি মাত্রা পশুপাখির মধ্যে। চারটি মাত্রা বুদ্ধিমান প্রাণী যেমন শিম্পাঞ্জি, বানর ইত্যাদির মধ্যে। পাঁচটি মাত্রা জিনের মধ্যে, ছয়টি মাত্রা মানুষের মধ্যে। ছয়টি মাত্রার ওপর ভিত্তি করে মানুষকে আবার ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- কারও মধ্যে একটি, কারও মধ্যে দুটি। একটি মাত্রা কোন মানুষের মধ্যে? মানুষ যখন মাতৃগর্ভে স্পার্ম থেকে পরিপূর্ণ আকৃতি ধারণ করে তখন তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জ্ঞানটি আসে, এ সময়ে সে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারে। এটা মা বুঝতে পারেন। মানুষের ক্ষেত্রে এ জ্ঞানটির ভূমিকা দুটি। খাদ্যের সংকেত দেওয়া এবং প্রাণের অস্তিত্বের প্রকাশ করা। যেমন- একজন মুষ্টিযোদ্ধা মাথায় আঘাত পেলেন, মাটিতে পড়ে গেলেন। এ সময় তিনি হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারবেন না। খেতে পারবেন না। কথা বলতে পারবেন না। এ জ্ঞানটি লোপ পেলে অন্য সব জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ জন্য এ জ্ঞানটিকে বলা হয় ফাউন্ডেশন অব অল ফ্রাগমেন্টস অব নলেজ। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মধ্যে দুটি মাত্রা। মূর্খদের মধ্যে তিনটি মাত্রা। চার মাত্রা বুদ্ধিমানদের মধ্যে। পাঁচটি মাত্রা আল্লাহর ওলিদের মধ্যে। ছয়টি মাত্রা ধর্ম প্রবর্তক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের মধ্যে। আমরা আল্লাহর ওলিও নই বা মনীষীও নই। আমরা বুদ্ধিমান। পৃথিবীর ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষ বুদ্ধিমান। আমাদের জ্ঞানের চারটি মাত্রা। গবেষণায় বলা হয়েছে, না, আমাদের জ্ঞানের মাত্রা তিনটি, একটি মাইনাস। যেটাকে বলা হয় বুদ্ধি। এটাকে বলা হয়েছে লেস ইমপর্টেন। আমাদের জ্ঞানের মাত্রা তিনটি। পশুপাখিরও তিনটি মাত্রা। ওরা যতটুকু চিন্তা করতে পারে তার চেয়ে বিন্দু পরিমাণ বেশি চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের মধ্যে মহাজ্ঞানীদের আবির্ভাব হয়েছে। তাদের জ্ঞান আমরা ধারণ করতে পারি, ইপ্লিমেন্ট করতে পারি। এই মহাজ্ঞানীরা যদি কোনো কালেই না আসতেন, আজও আমরা বন্যপ্রাণীর মতো বনে-জঙ্গলে উলঙ্গ হয়ে ফলমূল খেয়ে ঘুরে বেড়াতাম। তার নিদর্শন অ্যামাজন জঙ্গলের জনগোষ্ঠী। কোথাও কোথাও নারী-পুরুষের ইরোজিনাস জোন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। আমরা যে পশুপাখির চেয়ে বেশি চিন্তা করতে পারি না তার প্রমাণ এখানে। আমাদের গৃহিণীরা ভালো রান্না করতে পারেন। একটি শিশুকন্যাকে ২৫ বছর কোথাও বন্দি করে রাখেন। তাকে শাড়ি পরতে দেবেন না, কথা বলবেন না। ২৫ বছর পর বের করে নিয়ে আসেন, মেয়েটি কিন্তু কিছুই পারবে না। অথচ একটি সাপ ডিমের খোলস থেকে বের হয়েই দৌড়াতে পারে, ফণা তুলতে পারে, খেতে পারে, কামড় দিতে পারে। একটা মুরগির বাচ্চা ডিমের খোলস থেকে বের হয়েই দাঁড়াতে পারে, খেতে পারে, কথা বলতে পারে। মূলত আমাদের জ্ঞান হচ্ছে দুটো। খাদ্য এবং জৈবিক জ্ঞান। এ দুটোর মধ্যে মানুষ জন্মে একটি মাত্র জ্ঞান নিয়ে। যেমন শিশুটি এবং যে প্রাণীর মধ্যে তিনটি মাত্রা। মাতৃগর্ভ থেকে জ্ঞানের তিনটি মাত্রা নিয়ে জন্মে। যেমন সাপ ডিমের খোলস থেকে বের হয়েই দৌড়াতে পারে, ফণা তুলতে পারে, কামড় দিতে পারে। এবার প্রশ্ন শ্রেষ্ঠ কারা? অনেকে বলেন যে হিসাবে তো ওরাই শ্রেষ্ঠ। তাহলে কেন বলা হয় মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আশরাফুল মাখলুকাত। এ কথাটা কোরআন এবং হাদিসের কোথাও নেই। পবিত্র কোরআনের সুরা আল আরাফের ১৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাহাদের (মানুষের) কান আছে, শুনিবে না। চোখ আছে দেখিবে না। হৃদয় আছে হৃদয়ঙ্গম করিবে না। তাহারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো। বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর।’ মানুষের মতো এত নিকৃষ্ট প্রাণী উপমা দেওয়ার মতো খুঁজে পাওয়া যাবে না। আয়নাঘরের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। সতীদাহ প্রথা, আরবে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া। ভারতের কেরালাতে নরবলি প্রথা এখনো বলবৎ আছে। তবে মানুষ শ্রেষ্ঠ এর দুটো যুক্তি আছে। একটি ধর্মীয় যুক্তি। সুরা বাকারার ৩০ থেকে ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং কিছু বস্তুর নাম শিখিয়ে দিলেন। ফেরেশতাদের বললেন, তোমরা এ নামগুলো বলো। ফেরেশতারা বললেন, আপনি তো আমাদের এ নামগুলো শিখিয়ে দেননি। এরপর আল্লাহ বললেন, তোমরা আদমকে সেজদা করো। একজন ব্যতীত সবাই সেজদা করেছেন। তার মানে মানুষ ফেরেশতাদেরও ওপরে। এটা দুর্বল যুক্তি। মানুষের মধ্যে ছয় শ্রেণির মনীষী, যেমন ধর্ম প্রবর্তক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লৌহমানব, আল্লাহর ওলি এবং অক্ষরজ্ঞানহীন কিন্তু গ্রামে বিচার সালিশি করেন। এ ছয় শ্রেণির মানুষের কারণে সভ্যতার সূচনা, সভ্যতার উৎকর্ষ।
লেখক : দর্শনবিষয়ক গবেষক