বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কেন্দ্র করে অবৈধভাবে আটক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, আমরা খুনের নয়, এখন খুনির বিচার চাই।
গতকাল বেলা আড়াইটায় রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ের সামনে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে এ কথা বলেন তারা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার, অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী ও মানবাধিকার কর্মী শিরীন হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরীন, সরকারি সংস্থা উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা)-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ নূর, সদস্য রুমি প্রভা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধনে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। বিনা বিচারে তাদের আটকে রাখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল আদালত বললে তাদের ছাড়া হবে। এটা একটা অপপরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে ছিল। আমরা শুনেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের ছেড়ে দিয়েছে। তাদের মুক্তি হয়েছে এতে আমরা খুশি। কিন্তু এখনো অনেক ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ বিনা বিচারে আটকে আছে, সেজন্য আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা খুশি হলেও সন্তুষ্ট নই। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যে যেখানে আটক আছে, বিনা বিচারে কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা ছাড়া সব শিক্ষার্থীকে অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিবিসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যাচার, প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিটি ফোর্সই প্রতিটি বিষয়ে জনগণকে মূর্খ মনে করেছে। প্রতিটি কথায় তারা নিজেরাই মূর্খের পরিচয় দিয়েছে, সেটা তারা ভুলে গেছে। মিথ্যাচার করে সরকার পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সরে আসতে হবে। মিথ্যাচার দেশবাসী বুঝে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, এ হত্যার বিচার করতে হবে। হুকুমদাতাদেরও বিচার করতে হবে। সরকার মিথ্যাচার ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে টিকে আছে। যতক্ষণ আমাদের সব আটক ছাত্রকে মুক্তি না দেওয়া হয়, যদি হত্যার বিচার না করা হয়, যদি শিক্ষাঙ্গন খুলে না দেওয়া হয় অবিলম্বে, তাহলে আমাদের নাগরিক সমাজের আরও বৃহত্তর কর্মসূচি থাকবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ডিবির কাছে থাকলে নাকি নিরাপত্তাবোধ করে। আসলে আমাদেরকে নিরাপত্তার সংজ্ঞাটা দেবেন? আমরা সংবিধানে তুলে দেব। শিক্ষার্থীদের হেফাজতে রাখার আইনি সংজ্ঞাটা কী? শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার ক্ষমতা কোথায় দেওয়া হয়েছে? সংবিধানের কোন আইনে আটকে রাখার কথা হয়েছে?
তিনি বলেন, আমাদেরকে যখন ইচ্ছা তুলে আনবেন, যতদিন ইচ্ছা আটকে রাখবেন, নুডুলস খাওয়াবেন, পোলাও, রুটি খাইয়ে আবার পত্র-পত্রিকায় দেবেন। এগুলো কাদের টাকায় খাওয়ান? আমরা জনগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দিন মুখোমুখি হতে চাই না। আপনারা বাংলাদেশ পুলিশ হবেন। আওয়ামী লীগ পুলিশ, বিএনপি পুলিশ, জাতীয় পার্টি পুলিশ হবেন না। এটাই আমরা চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, সারা দেশে অজস্র কারাগার গড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা আটকের মাধ্যমে। জুলাইয়ের হত্যাকান্ডে যারা প্রাণ হারিয়েছে সেই আন্দোলনের হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে ব্লক রেইড দিয়ে কারাগারগুলো ভরে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থা আজই থামাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তুলে নিতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। মানুষের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। তাদেরকে আটকে রাখার অধিকার আপনাদের কারও নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী কারাগারে। আটকে রাখা সব শিক্ষার্থীকে মুক্তি দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী বলেন, আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আগামীকাল (শুক্রবার) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিকাল ৩টায় ‘দ্রোহ যাত্রা’ নামে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশে ছাত্র, শিক্ষক ও সুধীসমাজ অংশগ্রহণ করবেন। আমরা কেউই আলাদা না। আমরা এতগুলো হত্যার আর বিচার চাই না, এখন আমরা হত্যাকারীর বিচার চাই।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, আমার প্রশ্ন, আমরা কি কোনো জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি? যদি না থাকি তাহলে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার দিতে হবে। সভা-সমাবেশের অধিকার, বাকস্বাধীনতার অধিকার- এগুলো কেন নিশ্চিত করা হচ্ছে না।