আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, গুম অবস্থায় বারবার মনে হতো তারা হয়তো আমাকে ক্রস ফায়ার করে হত্যা করবে। রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম। আল্লাহ আমার লাশটা যেন কুকুরের খাদ্যে পরিণত না হয়। আমার লাশটা যেন আমার পরিবারের কাছে যায়। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের অডিটোরিয়ামে অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে আযমী বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ, আহত ও সম্মুখসারির যোদ্ধাদের বীরশ্রেষ্ঠ, বীর বিক্রমসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই খেতাব দেওয়া হোক। পিলখানায় ৫৭ জন সেনা অফিসারের খুনের বদলা চান উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোরআনে আছে খুনের বদলে খুন। আমি তদন্ত করে বিচারের আহ্বান জানাই। বিগত আমলে যারা তদন্ত করেছে, তারা দায়সারাভাবে করেছে। ওই হত্যাকান্ডের পূর্ণ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কীভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো বিষয়ে আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, যখন আমার বাসায় তারা আসলো, তখন তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম- আপনারা কারা, পরিচয় কী, পরিচয়পত্র দেখান। আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি না, জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমার কথার জবাব দেননি। আমার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। একপর্যায়ে আমাকে নিয়ে গাড়িতে চোখ বেঁধে দেয়। আমার চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় একটা জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানেই ফেলে রাখা হয়- অন্ধকার এক ঘরে। সেখানে দিন, না রাত- কিছুই বোঝা যেত না। টয়লেটে যেতে চাইলে চোখ হাত বেঁধে নিয়ে যেত।
মুক্তির ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬ আগস্ট আমাকে একজন জানাল, আজ আমাকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। একজন বলল, আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারব না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা পরে দেখলাম, ঠিক আছে। বাইরে কী হচ্ছে, সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিল। বলল, গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে ১২টা বাজে।
গাড়ি ভাড়া হিসেবে ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা আমাকে টাকা দিল। আমি বললাম ঢাকার ভাড়া কত? তারা বললো, ঠিক জানি না। বললাম, এখানে কত টাকা আছে। তারা বলল, ৫ হাজার টাকা। আমি বললাম, আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষী নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যত সেই টাকাই দিন। তারা বলল আপনি যা করেন- দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
মুক্তির সেই মুহূর্ত সম্পর্কে আযমী বলেন, যখন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। আমার মনে হচ্ছিল, ঝাঁপ দিয়ে উঠে পড়ি। পরে বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। বাসের এক যাত্রীর কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে তাদের ফোন করি। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে (রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়) নামিয়ে দিল। এরপর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ (৮ আগস্ট) ভোরে বাসায় পৌঁছি। আট বছর গুম থাকা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি আট বছর বন্দি থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনো আলো দেখিনি, আকাশ দেখিনি, সূর্য দেখিনি। প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয় থাকত। তারা খুব দুর্ব্যবহার করত আমার সঙ্গে। তাদের আচরণে আমার বন্দিদশা নিয়ে রাতের পর রাত কেঁদে কেঁদে সময় কেটেছে। আযমী বলেন, মাঝে মাঝে তারা চোখ এমনভাবে বাঁধত, মনে হচ্ছিল আমার চোখের মণি ফেটে যাবে। হাতকড়া পরা থাকতে থাকতে হাতে ঘা হয়ে যেত। আট বছর আমি এক অন্ধকার ঘরে ছিলাম, পৃথিবীর কিছুই আমি দেখতে পাইনি এ সময়। অন্যায়ভাবে আমাকে এখানে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দিজীবনে মৌন প্রতিবাদ হিসেবে নিজের চুল বড় রেখেছি।
ফিরে আসার পরের অভিজ্ঞতা বিষয়ে আবদুল্লাহহিল আমান আযমী বলেন, আমি ফিরে এসে জানতে পারলাম, আমার পরিবারের ওপর তারা কী পরিমাণ নির্যাতন চালিয়েছে। আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে চেয়েছিল তারা। একপর্যায়ে আমার স্ত্রীকে তুলে নিতে চাইলে স্ত্রী আমার মাকে সঙ্গে নিতে বললে তখন তারা তাকে নেয়নি। এ সময় আমার বাড়ির যুবতী কাজের মেয়ের ওপর হাত চালিয়েছে। বাসার ম্যানেজার ও দারোয়ানসহ সবার ওপর তারা হামলা চালায়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আযমী বলেন, ভারত কখনোই বন্ধুর মতো আচরণ করেনি। সীমান্ত হত্যা পানি বণ্টনসহ বাংলাদেশকে তারা শত্রুই ভাবে অথচ ভান ধরে বন্ধুর। এদের সঙ্গেও শত্রুর মতো আচরণ করা উচিত। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অনিয়ম অত্যাচার নিয়ে সোচ্চার থাকার কারণেই আমাকে আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। অন্তর্বতী সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান কোনো রকম জরিপ ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা প্রকাশ করেন। একটা যুদ্ধে কত মানুষ মারা গেলেন তার কোনো সঠিক সংখ্যা জাতি এখনো জানে না। শহীদের সংখ্যা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার আযমী বলেন, একটা জরিপ হয়েছিল যেখানে শহীদের সংখ্যা ২ লাখ ৮৬ হাজার বলা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত যেন নতুন করে লেখা হয়। বর্তমানে যে জাতীয় সংগীত চলছে তা করেছিল ভারত। দুই বাংলাকে একত্রিত করার জন্য করা হয়েছিল এই জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নতুনভাবে হওয়া উচিত। আর দেশের সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এই সংবিধান জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে করা হয়নি। গুম, খুন, হত্যা ও নির্যাতনের বিচার করতে হবে। সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে গুমের শিকার হন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের সন্তান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। দীর্ঘ আট বছর পরে গত ৬ আগস্ট দিবাগত রাতে তিনি ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।