প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার বা দ্বৈতশাসন সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে না। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। গতকাল সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণে এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে আয়োজিত এই অভিভাষণ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
আসিফ নজরুল তার বক্তব্যে বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার গায়েবি মামলা ও ঢালাও মামলার কালচার শুরু করেছিল। আমরা সেটা থেকে বের হতে চাই। প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। অন্যদিকে গত দেড় দশকে বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ঝান্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। নিজেদের বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে বিচারকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন খুলনার জেলা ও দায়রা জজ মাহমুদা খাতুন এবং নওগাঁর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বনাথ ম ল। উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও অধস্তন আদালতের বিচারকরা। অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বক্তব্যের শুরুতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অথচও বিচার বিভাগের সবচেয়ে শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস। তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটা বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধের নিশ্চয়তার নিরাপদ দুর্গে পরিণত হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয় বরং আইনের শাসন করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব তৈরি করে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যামান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ কার্যকরূপে পৃথক না হওয়া। এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এ ছাড়া আছে স্বচ্ছাতা ও জবাবদিহির অভাব। মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুন স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ ও স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে কোনো আইন না থাকা এবং প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়। যা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য জরুরিভিত্তিতে বিচার বিভাগের কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সহযোগিতা কামনা করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এ সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখন আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরিভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটিই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ। প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে বিচারকদের পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ঘোষিত নীতিমালা নেই।
ফলে পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই বিচারকরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে যথোপযুক্ত নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করব। শুধু বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা হিসেবে সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে যে বিধান রয়েছে কেবল সেটুকু নিশ্চিত করে বিচারক নিয়োগের ফলে সুপ্রিম কোর্টে এক অভূতপূর্ব অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসেবে পালন করেছে। এটি ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তাই উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে অন্যান্য দেশগুলোতে অনুসৃত আধুনিক পদ্ধতিগুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে একটি কলোজিয়াম ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হওয়ার কথাও জানান প্রধান বিচারপতি।
আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই : ঢালাও মামলা এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি থেকে বের হওয়ার কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের উদ্দেশে ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিচারপতিদের কাছে মানুষ বিচার চাইতে আসে। তারা বিব্রতবোধ করেন। কেন বিব্রতবোধ করেন আপনি? বিব্রতবোধ করবেন যখন আপনার ভাইবোন বিচার চাইতে আসে। বিচারপ্রার্থী মানুষ কোথাও বিচার না পেয়ে আপনার কাছে এসেছে। আপনি কীভাবে বিব্রতবোধ করেন?
প্রধান উপদেষ্টার এক মামলা নিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, আপনারা বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের আর্জি গ্রহণ করতে বিব্রতবোধ করেছিলেন। কেন করেছিলেন? আপনার এটা দায়িত্ব না? আপনার এটা সাংবিধবানিক দায়িত্ব না? আপনি শুনে (শুনানি গ্রহণ করে) রিজেক্ট (খারিজ) করে দেন। সমস্যা নেই। আপনি শুনবেনই না। আপনাদের সুনাম কিছু বিচারপতির কারণে ক্ষুণœ হয়েছে। এগুলো আর কইরেন না। মানুষ বোকা না। মানুষের বিচারবুদ্ধি আছে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার গায়েবি মামলা ও ঢালাও মামলার কালচার শুরু করেছিল। আমরা সেটা থেকে বের হতে চাই। অনেকের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হয়ে গেছে। ন্যায়বিচার নিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা ঢালাও মামলা, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা মানুষের জীবন-জীবিকাকে নিশ্চিহ্ন করা, মানুষের ক্রমাগত ক্ষত, ক্রোধ, কোন্দল সৃষ্টি করা থেকে বের হতে চাই।
বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ঝান্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে : গত দেড় দশকের দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ঝান্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, বিগত দেড় দশক সময়ে খুন, গুম, হামলা, মামলা, দমন, পীড়ন ও লুটপাটের মাধ্যমে নাগরিকদের ন্যূনতম মানবাধিকার কিংবা ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশি মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। ৭০০-এর বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। ৬০ লক্ষাধিক মানুষ গায়েবি মামলার আসামি হয়েছিলেন। কথা বলার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণের মাধ্যমে বিরোধী মত দমনের নিকৃষ্টতম ইতিহাস রচিত হয়েছিল।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সেই দুঃসময়ে আমাদের বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের ঝান্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। হয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন, নয়তো নতজানু অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জনধর্ম আছে। যা আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। আপনারা যেনে আনন্দিত হবেন, ৩৬ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়নি। তার মূল কৃতিত্ব যেতে পারে আমাদের শ্রদ্ধাভজন শিক্ষক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বের প্রতি। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা করি, নতুন সরকারের অন্যতম প্রথম প্রতিশ্রুতি হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বিচারব্যবস্থা, এ বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। ছাত্র-জনতার স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এটি হবে মূল ভিত্তি। তবে সে লক্ষ্য অর্জনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিচারকদের মানসিক স্বাধীনতা। নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম মনে করা। প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে মনে করা। যা প্রত্যেক বিচারকের মৌলিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, বিচার বিভাগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি। যা অর্থনৈতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি হতে পারে। জাতি প্রত্যাশা করে, বিচার বিভাগ যে কোনো ধরনের দুর্নীতি কিংবা সিন্ডিকেট মুক্ত থাক। দুর্নীতির প্রচলিত ধারণা অর্থনৈতিক লেনদেনকে বুঝালেও, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ডিনামাইটের চেয়েও ধ্বংসাত্মক। অ্যাটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ। ক্যান্সারের চেয়েও মরণঘাতী। সুতরাং শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে বিচার বিভাগের সব স্তর থেকে দুর্নীতি দূরীকরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব ও বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, বিপ্লব-উত্তর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করণের বড় সুযোগ আমরা হাতে পেয়েছি। আসুন আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগাই।