ফেনী জেলার প্রায় ১৫ গ্রামের লাখো মানুষ এখনো পানিবন্দি। নোয়াখালীতে খাল-নদী দখল-দূষণ-ভরাটের কারণে পানি কমছে ধীরগতিতে। লক্ষ্মীপুরে এখনো পানিবন্দি ৫ লাখের বেশি মানুষ। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ার গ্রাম এখন প্রাণহীন জনপদ। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ফেনী : ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে। সরেজমিন গতকাল ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিণ আবুপুরে গেলে দেখা যায়, এখনো কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপানি। জানা গেছে, এখনো জেলার ১৫ গ্রামের লাখো মানুষ পানিবন্দি। গ্রামের সড়কসহ বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে আছে।
জেলার ৫৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০টি ও ৩৫১টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪০টি খুলেছে। বন্যায় জেলায় মোট ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, জেলার ২২ আশ্রয় কেন্দ্রে এখনো ৪ হাজারের বেশি আশ্রিত রয়েছে। বন্যায় জেলার প্রায় সড়ক ভেঙে গেছে, পোলট্রি ও মৎস্য খাত সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষিজমি তলিয়ে গেছে।
বাড়ছে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি : গত দুই দিন ফেনী ও ভারতের ত্রিপুরা অংশে টানা বর্ষণের ফলে ভারতের উজান থেকে আবার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীতে পানি বাড়ছে। এ তিনটি নদীর অর্ধশতাধিক স্থান এ মুহূর্তে ভাঙা থাকায় পরশুরামে পানি ঢুকছে। গতকাল পরশুরাম উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের চারিগ্রাম দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে।
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে তিন দিন ধরে রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। এলাকাভেদে তিন দিনে এক থেকে দেড় ফুট পানি কমায় কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে বানভাসিদের মাঝে। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার অভ্যন্তরীণ অধিকাংশ সড়কের পানি নেমে গেলেও কিছু কিছু সড়কে রয়েছে হাঁটুপানি। এখনো পানিবন্দি ৫ লাখের বেশি মানুষ।
২০ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় পানিবাহিত রোগবালাই দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকায়। দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। এখনো কিছু এলাকায় হাঁটুপানি মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যবাঞ্ছানগরের কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঠিকমতো নামতে পারছে না উজান থেকে আসা পানি। ২০ দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। এদিকে বানভাসিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ৪১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৬৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
বুড়বুড়িয়া এখন প্রাণহীন জনপদ : কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ায় ২৩ আগস্ট রাতে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় শত শত বাড়িঘর। ধ্বংসস্তূপে রূপ নেয় বুড়বুড়িয়া গ্রাম। যেন প্রাণহীন জনপদ। বুড়বুড়িয়া গ্রামের ফয়েজ আহমেদ জানান, কৃষিকাজ করে তাঁর সংসার চলে। রাত তখন পৌনে ১২টা। মসজিদের মাইকে বলল গোমতীর বাঁধ ভাঙা পড়ছে। বউ আর দুটি ছেলেকে নিয়ে দিলেন দৌড়। দৌড়ের সময় পেছন দিক থেকে একটা ধাক্কার আওয়াজ শোনেন। এক ধাক্কায় তার ঘরটা ভেঙে নিয়ে গেছে গোমতী। ফয়েজ আহমেদ সেই ভয়াল রাতের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
বুড়বুড়িয়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গ্রামটির প্রবেশের সড়কটি পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ভাঙা অংশ দিয়ে এখনো তীব্র স্রোতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। সড়কের পাশের জমিতে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও বুকসমান পানি। সড়কের যে অংশ একটু ভালো সেখানে ডুবে যাওয়া বাড়িঘর থেকে আসবাবপত্র এনে পরিষ্কার করছেন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে আসা স্থানীয়রা।
ধীরেন্দ্রচন্দ্র দাস বুড়িচং উপজেলার ইন্দ্রাবতী গ্রামের বাসিন্দা। গোমতীর বাঁধ ভেঙে তাঁর বাড়িটি পানির সঙ্গে মিশে যায়। বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহিদা আক্তার জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের তালিকা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবেদ আলী জানান, বুড়িচংসহ বন্যাকবলিত ১৪ উপজেলার যেসব ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে সেগুলোর প্রাথমিক হিসাব করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৮১টি ঘরবাড়ি। এ তালিকা ঢাকায় পাঠানো হবে।
নোয়াখালী : নোয়াখালীতে এখনো কাটেনি বন্যার রেশ। ১০ দিন ধরে পানিবন্দি বিভিন্ন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বন্যাপরবর্তী খাদ্য সংকটের পাশাপাশি প্রাদুর্ভাব বেড়েছে পানিবাহিত রোগের। তাদের ঘরগুলোও এখনো বসবাস-অনুপযোগী। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে নারী, শিশু, বৃদ্ধরা। সোনাইমুড়ী উপজেলার দেউটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাঘাটে এখনো হাঁটুপানি। কোথাও বা তার একটু নিচে। ইউনিয়নের নবগ্রামের ব্যাপারীবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির সাতটি পরিবারই পানিবন্দি। সবার রান্নাঘরে পানি এখনো থইথই করছে। বসতঘর থেকে পানি নেমে গেলেও কাদামাটির মধ্যেই বসবাস করছে সাত পরিবারের ৪০ জন সদস্য। কোনো ঘরেই নেই মাটির চুলায় রান্নার ব্যবস্থা। শিশু, বৃদ্ধ আর অসুস্থ মানুষদের নিয়ে এ পরিবারগুলো পানিবন্দি দিন কাটাচ্ছে। জেলার চাটখিল ও সেনবাগ উপজেলায়ও পানি না নামায় দুর্ভোগে নাকাল বানভাসিরা। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা বলেছেন, নোয়াখালীতে পানি এসেছে ধীরে ধীরে। এখন যাচ্ছেও ধীরে। একটা ইউনিয়নে পানিবন্দি হাজারো পরিবার থাকলেও পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা নেই। সোনাইমুড়ী উপজেলায় ত্রাণ বিতরণের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, ‘এখনো বন্যার পানি নামছে না। অনেকের বসতঘরে এখনো পানি, রান্নার চুলাও জ্বলছে না। কেউ কেউ এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন।’ নোয়াখালীতে পানি ধীরগতিতে নামার কারণ হচ্ছে খাল-নদীর দখল-দূষণ-ভরাট। দীর্ঘদিন থেকে অবৈধভাবে দখলে থাকা খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার করার দাবি জানিয়েছেন পানিবন্দি মানুষ।