ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কার্যত স্থবির সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কমিশনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে কোনো পরীক্ষাও নিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে চাকরি প্রার্থীরা আন্দোলন করে কমিশনের পদত্যাগের দাবি তোলেন। ফলে কমিশনের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনসহ সব সদস্য পদত্যাগ জমা দিয়েছেন। পিএসসির সচিবের মাধ্যমে তাদের পদত্যাগপত্র বঙ্গবভবনে পাঠানো হয়েছে। স্থবিরতা কাটিয়ে পিএসসি সঠিকভাবে চলুক সে প্রত্যাশা করেছেন অনেকে।
গতকাল পিএসসির সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পিএসসিতে চেয়ারম্যানসহ ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ১৩ জন আমাদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কমিশনের এই পদত্যাগপত্রগুলো মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
পিএসসির একাধিক সূত্র জানায়, এসব পদত্যাগপত্রে বেশির ভাগই ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করেছেন। জানা গেছে, যে দুজন সদস্য কমিশনের কাছে পদত্যাগ দেননি তারা হলেন- শফিকুল ইসলাম এবং হেলালুদ্দিন। নাম প্রকাশ না করে এক সদস্য বলেন, আমরা পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। আশা করছি পিএসসিতে কার্যক্রম বিদ্যুৎ গতিতে হবে। আমাদের সময়ে স্থবির হলে তা এখন নতুন কমিশন নিশ্চয়ই দ্রুতই কাটাতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উপযুক্ত লোক নিয়োগ দেওয়া হলে সব সমস্যা কেটে যাবে। তিনি আরও বলেন, যে কমিশন ছিল তাদের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয় অনেকের মধ্যে। একই সঙ্গে একজন চেয়ারম্যান দিয়ে তো আর কমিশন চলে না। বাকিদের বাচবিচার করে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সবকিছু মিলেই সরকার পতনের পর প্রতিষ্ঠানে অনেকটা স্থবিরতা নামে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রদবদল শুরু হয়। তবে পিএসসিতে কমিশনের কোনো রদবদল না থাকায় চেয়ারম্যানসহ কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে নানা আন্দোলন, মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক তৈরি হয়। এ ছাড়াও অফিশিয়াল হাজিরা ছাড়া দৃশ্যত কোনো কাজই করতে পারেনি কর্মকর্তারা। ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি যথাসময়ে প্রকাশ করা নিয়েও দেখা দেয় সংশয়। সর্বশেষ গত সোমবারও সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পিএসসির সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন পিএসসি সচিবালয়। এ সময় নিরাপত্তার স্বার্থে গেটে তালা লাগিয়ে দেন আনসার সদস্যরা। চেয়ারম্যানসহ সদস্যদের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন চাকরিপ্রার্থীরা। এর আগেও কয়েক দফায় এমন পরিস্থিতিতে পরে কমিশনে কর্মরতরা। তবে এসব আন্দোলনের মধ্যেও একাধিকবার কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। চাকরিজীবীদের বিভাগীয় পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবরের পর থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা ধাপে ধাপে নেওয়ার পরিকল্পনা নেয় কমিশন। তার আগেই বিদায়ঘণ্টা বাজল এ কমিশনের। পিএসসি সংস্কার নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম গত শনিবার বলেন, এ সপ্তাহের মধ্যে পিএসসি সংস্কার করে চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরির পরীক্ষাগুলো শুরু করতে হবে। যে তরুণ প্রজন্ম এই অভ্যুত্থানের অগ্রনায়ক তাদের প্রায়োরিটির কথা ভুলে গেলে চলবে না।
পিএসসির কয়েকটি সূত্র জানায়, জুলাই অভ্যুত্থানের কারণে ওই সময় স্থগিত হওয়া বিসিএসসহ অন্য চাকরির নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষাগুলো এতদিনেও শুরু করতে পারেনি কমিশন। এর কারণ হিসেবে পরীক্ষা শাখার কর্মকর্তারা বলেন, এখানে সমস্যা ছিল সিদ্ধান্তহীনতা। কমিশন হয়তো এখন পরীক্ষা নিতে চায়নি। পরীক্ষা নিলেও সেটি গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারত। কেননা প্রতিদিনই আমাদের অফিস থেকে কার্যক্রম বন্ধ করে অনেকটাই পালাতে হয়েছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, প্রস্তুতি আছে পরীক্ষা নেওয়ার তবে কমিশন নিয়ে প্রতিনিয়ত যে আন্দোলন ছিল সেটির কারণে পদত্যাগের ঘোষণাও আসছিল না আবার কোনো সিদ্ধান্তও জানাচ্ছিল না এজন্য এখনো সেভাবেই চলছে। তবে পদত্যাগের খবর শুনেছি এখন নতুন কমিশন হলে দ্রুতই নিশ্চয় কোনো উদ্যোগ নেবেন। জানা গেছে, বন্ধ পরীক্ষা চালু না করা এবং নতুন পরীক্ষা নেওয়ার কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী।
সূত্রগুলো জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে গত ১৮ জুলাই থেকে বিসিএসসহ নিয়োগ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করতে শুরু করে পিএসসি। ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা স্থগিত করা হয় প্রথমে এরপর ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও খাতা মূল্যায়নসহ অন্য কাজগুলো অনেকটাই বন্ধ। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, পদোন্নতির পরীক্ষাগুলোও স্থগিত রেখেছে পিএসসি। অনেক নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলও আটকে গেছে। সরকার পতনের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর পিএসসি সংস্কারের দাবি উঠলে সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন কমিশনের সদস্যরা। কমিশনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে একাধিক চিঠিও দেয় পিএসপি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কোনো দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি দাবি পিএসসির একাধিক কর্মকর্তার।