পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে ভেঙে যেতে শুরু করে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়িতে সাধু-ফকিরদের হাট। ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনের উৎসবমালার দ্বিতীয় দিনে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এবারই সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার মানুষের জন্য আয়োজন করা হয় ইলিশ মাছ ভাজা ও দই দিয়ে পূর্ণভোজের। পূর্ণসেবা শেষে আখড়াবাড়ি খালি করে ছেড়ে যেতে শুরু করেন সাধু-বাউলরা। আবার মিলিত হওয়ার আশা নিয়ে আখড়াবাড়ি ছেড়ে যান তাঁরা। বিদায়ের সময় অনেক সাধু-ফকির কান্না করেছেন। কেউ গেছেন চোখ মুছতে মুছতে। যার যার এলাকায় গিয়ে লালনের মানবতার দর্শন প্রচারের কথা বলেছেন তাঁরা।
প্রবীণ সাধু মোহাম্মদ আলী ফকির বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে ফকির লালন সাঁই এ ছেঁউড়িয়ায় দোলপূর্ণিমার তিথিতে সাধুসঙ্গ করতেন। গানে গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক লালন সাঁইজির দেহত্যাগের পর থেকে যুক্ত হয়েছে আরেকটি অনুষ্ঠান। দোল উৎসবের আদলে ১৩৪ বছর ধরে তিরোধান উৎসবেও সাধু-বাউলরা লালনকে স্মরণ করছেন। বসছে সাধুসঙ্গ। ১৩৪তম তিরোধান দিবসেও ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যার পর শুরু হয় সাধুসঙ্গ। রাতেই হয় অধিবাস। পরদিন ১৮ অক্টোবর সকালে বাল্যসেবা এবং বিকাল ৩টায় পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে অষ্টপ্রহরের এ সাধুসঙ্গ। এবার এত বেশি সাধু-ফকির ও বাউল আসেন কুষ্টিয়ায় যে ছেঁউড়িয়ার লালনের আখড়াবাড়ির ভিতরে পা ফেলার স্থানটুকু ছিল না। যে যেখানে পেরেছেন আসন পেতে বসেছেন। এমনকি অনেকেই পায়ে চলা রাস্তার ওপর আসন পাতেন। এ সময় সাধু-ফকিররা তাঁদের সাঁইজির বাণী নিয়ে আলোচনা করেছেন। পুরো আখড়াবাড়ি যেমন জনারণ্য, তেমন জাতপাতহীন, মানবতাবাদী, অহিংস লালন দর্শনের গানেও প্রকম্পিত। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আসন পাতেন সাধু-বাউলরা। দলে একজন গুরু থাকেন বাকিরা শিষ্য। যেহেতু লালনের তিরোধান দিবস ঘিরে এবারের সঙ্গ, সে কারণে দৈন্য প্রকাশের গানই শোনা গেছে চারদিকে। আখড়াবাড়ির বাইরে মঞ্চেও আলোচনা ও গানে প্রকাশ পেয়েছে লালনের তিরোধানের বিষয়টি। একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে তাঁর মানবতাবাদও। সামান্য বৃষ্টি হওয়ায় দুপুরের পূর্ণসেবার আয়োজন কিছুটা বিলম্বে করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির সদস্য সাজেদুর রহমান বিপুল। তিনি বলেন, এবারই প্রথম ১৪ হাজার মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। মেনুতে ছিল ইলিশ মাছ ভাজা, ডাল, সবজি, সাদা ভাত ও দই। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ৭০০ কেজি ইলিশ আনা হয়েছে। পূর্ণসেবার আয়োজনের সময় লালনের আখড়াবাড়ির গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবাই লাইন দিয়ে বসে যান। এরপর সব আইটেম পাতে পাতে দেওয়া শেষ হলে মাইকে আলেক সাঁই ঘোষণা দেওয়ার পর একযোগে খাবার নেন সাধু-ফকিররা। তবে উৎসব যেহেতু আরও এক দিন থাকছে সে হিসেবে থেকে যাবেন অনেকেই। সাধুরা বলেন, এখানে সাধু-গুরুর ভাববিনিময়ের মাধ্যমে চরিত্র গঠন হয়। সবাইকে সত্যবাদী, জিহাদি, কষ্টসহিষ্ণু ও অল্পতেই তুষ্ট থাকার মতো চরিত্রবান হতে হবে। লালন গবেষক ফকির হৃদয় শাহ বলেন, ফকির লালন সাঁইজির দর্শন আজ মনের ভাষায় একীভূত হয়ে গেছে। তাঁর মানবতাবাদী দর্শনের গভীরতা মানুষ আজ ধারণ করতে শিখেছে। শান্তি, প্রশান্তি, বিশ্বাস সবই সাঁইজির ভাবধারায় রয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ যে অশান্তির আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে বেঁধে ফেলেছে এর ভিতর থেকেও সাঁইজির দর্শন ধারণ করে শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন। মানুষ ভজনের মধ্য দিয়ে সহজেই সত্যিকারের প্রেম খুঁজে পাচ্ছেন। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরায় মনিটরিং করা হচ্ছে। তা ছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যুক্ত করা হয়েছে। আখড়াবাড়ির বাইরে লালন একাডেমির মাঠে স্থায়ী মঞ্চে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিরোধান দিবসের তিন দিনের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় অতিথি বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কবি ফরহাদ মজহার। এখানে আলোচনা শেষে রাতভর চলে লালন সংগীতানুষ্ঠান। গান পরিবেশন করেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা।