হোর্হে লুইস বোর্হেস বলেছেন, ‘কবিতা কিংবা যে কোনো সাহিত্যকর্ম বিশুদ্ধ শিল্প। প্রতিবার কবিতা পড়ার সময় শিল্প সৃষ্টি হয়। আমরা সত্যিকার অর্থে কবিতা বলতে বুঝি আবেগ এবং আনন্দ। আমরা কবিতার দিকে এগোই আমরা জীবনের দিকে এগোই। (কবিতার কারখানা-অনুবাদ অপূর্ব জামান)। কবিতার মূল অনুষঙ্গ হচ্ছে আবেগ। এই আবেগ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দৃশ্য শিল্পের সৌন্দর্যের কোলাজ তৈরি করে। আমরা জানি কিটস বায়রন, কোলরিজ, শেলি প্রমুখ রোমান্টিক কবি সৃজনশিল্পে কমবেশি আবেগ আক্রান্ত ছিলেন। এই ‘আবেগ’ কবিতা বা শিল্পের সব সময়কে ধারণ করে আছে কল্পনার মাধুর্যে। কবিতায় আবেগের ভিন্নমতও আছে, যেমন, এলিয়ট মনে করেন, ‘পোয়েট্রি ইজ নট এ ট্রানিং লুজ অব ইমোশন’। সমকালীন কোনো কোনো কবিও ভাবতে পারেন, কবিতা তীব্র আবেগ আশ্রিত নয়, কবিতা হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ বোধের শিল্প। তবে অস্বীকারের উপায় নেই- বিষয়টি দ্বিধামুক্ত নয়।
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তার ‘রূপ, রস ও সুন্দর’ নন্দনতত্ত্বের ভূমিকাগ্রন্থে লিখেছেন, ‘শিল্পবস্তু সৃষ্টিতে স্বভাবতই সৃষ্টিশীল কল্পনার ভূমিকা মুখ্য এবং প্রত্যক্ষ লক্ষ্যবস্তুর প্রতিচ্ছবি। স্মৃতিতে ধরে রাখার বা কল্পনায় জাগিয়ে তোলার ভূমিকা গৌণ। সৃষ্টিশীল কল্পনাবস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অংশগুলোকে সংবদ্ধ করে শিল্প বাস্তব রূপ দেয়। মূলত শিল্পীর সৃষ্টিতে শিল্পবস্তু এক অর্থে বস্তু ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র (পৃ: ১০৮)।
শহীদ কাদরী কবি। আপাদমস্তক কবিতার চাদর জড়িয়ে শীতার্ত রাত-দিন পথ হেঁটে কবিতার দামাল হাওয়ায় ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে পার করেছেন নির্ঘুম রাত। তিনি যথাথই বাস করতেন কবিতার ঘরে। কবির উচ্চারণ, ‘কবিতা আরাধ্য আমার এবং বিব্রত/ তার জন্য কম কিছু নই/’ কবিতা লিখেছেন কম তবে খ্যাতি পেয়েছেন ঈর্ষণীয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তাঁর কবিতা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন, সম্ভবত আটাত্তরে শহীদকে দেখি কোলন শহরে। আমি বুঝতে পারলাম ও নিজের মধ্যে প্রত্যেক কবির মতো অপূর্বভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। একদিকে এই প্রথম আমাকে দেখবার এক অপূর্ব আনন্দ অন্যদিকে যেটা দেখলাম সেটা হলো সে কোনো বন্দিতে নির্মিত হওয়ার মতো মানুষ নয়, সে এক অদ্ভুত মানুষ শনাক্ত হতে চায় না। ইংরেজিতে বলব, ওয়ান হু ডাজন্ট ওয়ান টুবি আইডেন্টিফাইয়েড’। এই যে দ্বিধা-বিভক্ত রূপটা দেখেছিলাম, একদিকে অসামান্য লাজুক, অসামান্য সংবেদী, অন্যদিকে বিশ্ববাসী। ওই সময়টাতে আমি বুঝেছিলাম ওকে কলকাতা বা ঢাকায় ধরে রাখা যাবে না।’ শেষ অবধি শহীদ কাদরীকে ধরে রাখা যায়নি ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’।
বিশুদ্ধ কাব্যভুবনের এই পরিব্রাজক তাঁর কবিতায় ধারণ করেছেন উন্মাতাল সময়ের নিপুণ দৃশ্যকল্প যদিও তার প্রকৃত বাল্যকাল মানেই রাজপথ, প্ল্যাকার্ড, সিপাই, এভেনিউ-দুর্ধর্ষ যৌবন মানেই বুলেট, বেয়নেট, মিছিল, মার্চপাস্ট, মাতাল, জুয়াড়ি, বেশ্যা। আর অন্যত্র রাষ্ট্র মানেই কারফিউ ১৪৪ ধারা... রাষ্ট্র মানেই স্ট্রাইক মহিলা বন্ধুর সঙ্গে এনগেজমেন্ট বাতিল। অথবা মার্কসিজম মানেই শহীদ কাদরী ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’-এর মতো নিস্তব্ধতা মানেই কখনো না দেখা এক কবিতার সম্রাটের প্রতিকৃতি/ ‘যারা গাও গেরামের মানুষ/ তাদের গ্রাম আছে, মসজিদ আছে/ সেলাম প্রণাম আছে।/’ আমার সেলামগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে একজন সমরবিদ’- তবু অবিকল তোমার চুম্বনগুলো পৌঁছে গেছে মানুষের কাছে যারা বেঁচে আছে তোমার কবিতার দেশে প্রতিদিন।
শহীদ কাদরী বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রাখেননি বেশ কয়েক বছর। অন্যদিকে ষাটের শুরুতে যখন লেখা শুরু করেন তখনো তুমুল আড্ডায় যত সময় খরচ করেছেন- তত সময় তিনি কবিতায় দেননি। দশক বিবেচনায় নয়, বাংলাদেশের কবিতায় পঞ্চাশের দশকের পর থেকে যে কজন কবির নাম উচ্চারিত হয়, শহীদ কাদরী তাঁদের অন্যতম। শহীদ কাদরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘উত্তরাধিকার’ (১৯৬৭) প্রকাশের পরই অভাবনীয় ঈর্ষণীয় সাড়া পড়ে যায় বাংলার কাব্যভুবনে। এরপর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। সেদিনের মতো আজও তরুণ কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এ কাব্যগ্রন্থের অজস্র প্রিয় পঙ্ক্তি। ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ (১৯৭৮) এই কাব্যগ্রন্থে তিনি ভাব ও বিষয়ের দিক থেকে আরও ব্যাপক-বিস্তৃত হন এবং পরিশীলিত স্বতন্ত্রকাব্য ভাষারূপ পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কবিতা নিয়ে এ কথা কখনো বলা যাবে না- ‘আধখানা তার ভাঙাগলা, আধখানা তার সাধা।’
মার্ক্সীয় রাজনৈতিক পাঠ ও বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের যে দর্শন, তা অভিজ্ঞতায় গ্রহণ করেও শহীদ কাদরী বিশেষ মতাদর্শের কবি হয়ে ওঠেননি। বিজ্ঞান যে মানুষকে বার বার নতুন করে রূপান্তরিত করে এবং জড়বস্তুর ভেতর ও প্রাণের স্পন্দনের সঞ্চার করে তা তাঁর নিবিড় উচ্চারণে- ‘পাথর তোমার ভেতরেও উদ্বৃত্ত/ রয়েছে আর এক নৃত্য’।
শহীদ কাদরী আত্মমুক্তি ও অস্তিত্ব সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন সমষ্টির ভিতর থেকে। সচেতন ছিলেন শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। নাগরিক জীবনবোধ, জীবনের কোলাহল। ফলে মুখর শব্দাবলি তাঁর কবিতাতেই প্রথম ও বিচিত্রভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপিত হওয়ায় তিনি বাংলা কবিতায় নাগরিক কবি হিসেবে অনন্য হয়ে ওঠেন। তবে এ কথাও সত্য তিনি ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে অভিহিত হলেও তাঁর বিভিন্ন কবিতায় গ্রামীণ জীবনের সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনার দৃশ্যাবলি চিত্রিত হয়েছে নিবিড় মমতায়-ভালোবাসায়। কবির উচ্চারণ-‘তরমুজ ক্ষেতের ওপারে আমার/ কোনো আটচালা নেই/ অথচ দু’ধারে আছে সারি সারি হীরার পাতের মতো জ¦লে ওঠা তোমাদের নিজস্ব করোগেট, টোম্যাটোর লাল/’ (দাঁড়াও আমি আসছি)। অথবা ‘আমি তোমাদেরই দিকে যেতে চাই/ ঝকঝকে নতুন একটি সেতু/ যেমন নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঐ লোকগুলোর কাছে পৌঁছে যেতে চায়/ কিন্তু তামা ও পিতলসহ বাসন-কোসন, চিড়ে-গুড় ইত্যাদি গোছাতে/ তোমরা ব্যস্ত, বড্ড বেশি ব্যস্ত’/ (কেন যেতে চাই)।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রেম। এই প্রেমকে শহীদ কাদরী মানব-মানবীর পর্যায় থেকে শুরু করে দেশ প্রেমে বিস্তার ঘটিয়েছেন। আবার কখনো এই প্রেমকে বিচিত্রভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহুমুখী বিভাজনে। খুলে দিয়েছেন অন্ধ-বন্ধ সকল জানালা-দুয়ার- ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতায় কবির উচ্চারণ-‘ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে/ শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন/ আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে/ গণ চুম্বনের ভয়ে/ হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা/’ মূলত এই প্রেমের বিস্তার কেবল সর্বজনীন নয়-সর্বকেন্দ্রিক। এই প্রেম ছড়িয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে মানব থেকে দেশ ও প্রকৃতির শীর্ষবিন্দু। প্রেমের অনুষঙ্গে অন্য কবির ভাবনা থেকে শহীদ কাদরীর মন মননে উচ্চারিত হয় স্বতন্ত্র বোধের শিল্পস্বর। তিনি বলেন, ‘বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/ মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ/ কালো রাত/গুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ/ প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না.../’
কবি মাহমুদ আল জামান বলেছেন- ‘শহীদ কাদরী দীক্ষিত হয়েছেন এবং তাঁর রুচি গঠন হয়েছে ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে রস গ্রহণ করে। বিশেষত তিরিশের দশক থেকে আন্তর্জাতিক কাব্যাঙ্গনে এবং বাংলা কবিতায় যে সব প্রবণতা নানাভাবে পল্লবিত হয়ে শিল্প-সাহিত্যের ভাবাকাশকে সমৃদ্ধ করেছিল তার সঙ্গে শহীদ কাদরীর নৈকট্য ছিল। তিনি প্রাণিত বোধ করেছেন এবং তাঁর সৃজনভূমি নব উদ্ভাবনীতে ঋদ্ধ করেছেন।’
কবিতা লেখার বাইরে শহীদ কাদরী বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করতে পছন্দ করলেও তিনি তা প্রকাশ করতে চাননি। ‘অমৃতের সন্তান’- নামে অনুবাদ করেছেন ইউজিন ও ‘নীলের একটি অনবদ্য নাটক’। এ ছাড়া রয়েছে প্রিয় কবি পাবলো নেরুদা, কনস্তানতিন কাভাফি, ইয়ালিস রিতসোস ও আন্তোলিন বার্তুসেকের কবিতা।
চির বোহেমিয়ান এই কবি নিজের সম্পর্কে উচ্চারণ করেছেন-‘না, শহীদ সে তো নেই, গোধূলিতে তাকে/ কখনো বাসায় কেউ কোনো দিন পায়নি, পাবে না/ চাকুরিতে মন নেই/ না, না, তার কথা আর নয়, সেই/ বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো শহীদ কাদরী বাড়ি নেই/’ শহীদ কাদরীর বন্ধু শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখ কবি কাব্য ভুবনে ভ্রমণ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন পথে। এ বিষয়াটি আরও গভীরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে শহীদ কাদরীর শেষ দুটি কাব্যগ্রন্থে ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯) এবং ‘গোধূলির গান’ (২০১৭) এর কবিতার বিষয় ও স্বতন্ত্রস্বরে। তিনি সর্বতো অর্থে বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি। পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কাব্যভুবনের দশদিক আলোকিত করেছেন শহীদ কাদরী। তুমুল আড্ডাবাজ যাপিত জীবনে বিদগ্ধ এই কবি অন্যসব ভুলে থাকলেও, কবিতা ভোলেননি। কবিতাই ছিল তাঁর স্বপ্নময় আরেক জীবন।
ঢাকা শহরের বিউটি বোডিং, ক্যাপিটেল, রেক্স, লাসালি, ওয়ারি, পেরিয়ে মধ্য রাত কিংবা শেষ রাতে ভোরের ফুটিফুটি আলোয় রেলওয়ে প্ল্যাটফরমে যে আড্ডা তাঁর সে তো রকমফের আছে নিশ্চয়ই। প্রেম, অপ্রেম, পরনিন্দা, নৈঃসঙ্গ আর রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করত। কিন্তু কোনো দিন কবিতাকে তারা ছেড়ে যাননি। মন-মননে শিল্প-সাহিত্যই ছিল আলোচনার শেষ শীর্ষবিন্দু।
তাঁর অস্তিত্ব একীভূত হয়ে আছে ব্যক্তি, স্বকাল, সমাজ, স্বদেশ, বিশ্ববীক্ষ, সময়ের অস্থিরতায়। অন্তর্দহনের প্রতিরূপক ও চিত্রকল্প নির্মাণে শহীদ কাদরী বাংলা কবিতায় ঈর্ষণীয় নতুন দিগন্তকে আলোকিত করেছেন। খ্যাতিমান এই কবি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে ২৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। শেষ কথা বলা যায়, শহীদ কাদরীর জন্মদিন আছে, মৃত্যুদিন নেই কোনো।