মৃত্যু মানে কি এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়া? ‘জলৌকা হে নীল যমুনা’র কবি শামসুল ইসলাম তার এক কবিতায় পৃথিবী থেকে মানুষের প্রস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘এক গ্রাম ছেড়ে কেন অন্য গ্রামে চলে যেতে হয়’। জীবনবাদী এই কবি তেপান্তরের ওপারে ভিন্ন গাঁয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই পোষণ করতেন না। তবে স্বীকার করতেন মৃত্যুর অনিবার্যতা। যা থেকে রেহাই পাননি তিনিও।
কবি শামসুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় তার খুলনায় অবস্থানকালে। রেডিও বাংলাদেশের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। খুলনার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের বিশেষ প্রিয়জনে পরিণত হন কবি শামসুল ইসলাম।
ইসলাম ভাই থাকতেন জোড়াগেট পেরিয়ে নূরনগরে রেডিও বাংলাদেশের স্টাফ কোয়ার্টারে। আমাদের বাড়ি খুলনা নিউমার্কেটের কাছে- সোনাডাঙ্গায়। আমি সে সময় নিয়মিত আড্ডা জমাতাম নিউমার্কেটের দোতলায় প্রশস্ত বইয়ের দোকান স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সে। কবি শামসুল ইসলাম, বন্ধুবর ছড়াকার ফারুক নওয়াজ প্রায়ই সে আড্ডায় যোগ দিতেন। কখনো কখনো আমরা সন্ধ্যার পর যশোর রোডের মাঝ বরাবর রোড ডিভাইডারে বসে আড্ডা জমাতাম। কখনো বাদাম, কখনো পেয়ারা, এমনকি ঘন বিচিময় পাকা ‘দয়া কলা’ খাওয়ারও মহোৎসব চলত সেসব আসরে। ইসলাম ভাই মিষ্টি পছন্দ করতেন। আর ফারুক নওয়াজ এবং আমার মিষ্টি আসক্তি ছিল বন্ধু মহলের আলোচ্য বিষয়। সম্ভবত মাসের ২ কি ৩ তারিখ। সরকারি চাকরিজীবীদের এ সময় পকেটের অবস্থা ভালো হওয়ার কথা। ফারুক নওয়াজ এ সুযোগটি একদিন গ্রহণ করলেন অন্যভাবে। আড্ডায় কবিকে লক্ষ্য করে বললেন- ইসলাম ভাই, আজ পকেট খুব গরম। লেখার বিল পেয়েছি। আপনাদের মিষ্টি খাওয়াব। আমাদের দুজনকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে বেশ মিষ্টি খাওয়ালেন। কিন্তু বিল দেওয়ার সময় পকেট হাতড়ে বললেন হায়, মানিব্যাগ তো ভুলে রেখে এসেছি। ইসলাম ভাই বুঝলেন এটি নওয়াজের সাজানো নাটক। কৃত্রিম রাগ করে বলেন- ফারুকক্যা তুই আমাদের ধোঁকা দিছিস। আমরা তো বেজায় খুশি কবিকে ঠকাতে পেরে। ফারুক নওয়াজ অবশ্য তখন দুষ্টুমি এবং বেপরোয়া আচরণের জন্য বন্ধু মহলে বেশ পরিচিত ছিলেন। বন্ধু-বান্ধবদের এমন কেউ নেই যে তার শিকার হয়নি। কবি শামসুল ইসলামের স্নেহভাজনদের তালিকার শীর্ষে ছিল নওয়াজের নাম। প্রায়ই বলতেন, আমি ওর ছড়ার ভক্ত। ফারুক নওয়াজও কবিকে দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে। তারপরও শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজ কবিকে নিয়ে দুষ্টুমির কমতি ছিল না তার। ইসলাম ভাইও মজা পেতেন।
মনে পড়ছে ছড়াকার জ্যোতির্ময় মল্লিক সম্পাদিত কুটুম পাখিতে ইসলাম ভাইকে নিয়ে লেখা একটি ছড়ার কথা। কুটুম পাখিতে একই সংখ্যায় একই পৃষ্ঠায় কবি শামসুল ইসলাম ও ফারুক নওয়াজের ছড়া ছাপা হয়। ইসলাম ভাইয়ের ছড়ার বিষয়বস্তু বা নাম কিছুই চার দশক পরে মনে নেই। তবে আকার-ইঙ্গিতে তাকে নিয়ে লেখা ফারুক নওয়াজের ছড়াটি এখনো মনে আছে। ছড়াটি এ রকম-
শ্বশুরবাড়ি গহরডাঙ্গা/নিজের বাড়ি দেয়ানা/যদিও তিনি নোয়াখাইল্যা/কিন্তু বড়ো শেয়ানা/হাঁসকে তিনি কাওয়া কন/আগুনটাকে হাওয়া কন/খেয়াঘাটের খেয়াটাকে বলেন, ওটা খেয়া না/যদিও তিনি নোয়াখাইল্যা কিন্তু বড়ো শেয়ানা/।
ফারুক নওয়াজের এ লেখাটি খুলনার সাহিত্য মহলে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করে। ইসলাম ভাইও উপভোগ করেন তা সহজভাবে। সরল সোজা এ মানুষটিকে তারই একজন স্নেহভাজন ছড়ার মধ্যে ‘শেয়ানা’ বলে ভাবতে চাইছে, মজার বৈকি! নওয়াজকে দেখেই কবি শামসুল ইসলাম বলেন, ফারুকক্যা তুই আমারে নিয়া কী লেখছস? খুলনায় জাসদের রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় লিখতাম সেই সত্তর দশক থেকেই। ঝোঁক ছিল শিশু সংগঠনের প্রতি। খুলনার সোনাডাঙ্গায় একবার আমি ও ফারুক নওয়াজ এক শিশু উৎসবের আয়োজন করেছিলাম। ইসলাম ভাইকে সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করা হয়। সাদামাটা অথচ জমজমাট উৎসবী আয়োজনে কবি শামসুল ইসলাম তো বিমুগ্ধ। আমাকে প্রশ্ন করেন, তুই তো রাজনীতির লোক। সারা দিন ব্যস্ত থাকিস মিছিল-মিটিং নিয়ে। শিশুদের সময় দিস কীভাবে? খুলনায় আমরা গড়ে তুলেছিলাম ছড়া সংসদ। ফারুক নওয়াজ ছিলেন এ সংসদের মধ্যমণি। পরিকল্পনাটা ছিল আমার। ফারুক নওয়াজ বিদ্রোহ ও বিপ্লবাত্মক ছড়া লিখতেন। তাকে কেন্দ্র করে আমরা ছড়াকে আন্দোলনের বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম হই। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও ’৭৭ থেকে ’৮১ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় আমারও প্রচুর ছড়া ছাপা হয়। ইসলাম ভাই রাজনীতি থেকে শত যোজন দূরে অবস্থান করতেন। তারপরও ছড়া সংসদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল। তিনি উৎসাহ দিতেন। অনুপ্রেরণা জোগাতেন। ফারুক নওয়াজের প্রশংসা করে বলতেন তোরা ছড়াকে আন্দোলনের হাতিয়ার বানাতে পেরেছিস। এটি বাহবা পাওয়ারই যোগ্য। আমাদের আড্ডায় কখনো কখনো যৌথভাবে ছড়া লেখার চেষ্টা চলত। মনে পড়ছে এক আড্ডায় ইসলাম ভাই লিখলেন ছড়ার একটি লাইন। ফারুক নওয়াজ ও মিলন মাহমুদের সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড় হলো চমৎকার একটি ছড়া। ছড়াটি হলো- বড় এক ভাই ছিল ঔরঙ শর্মার/গিয়েছিলো আরাকান নিকটেই বর্মার/হঠাৎ কপাল দোষে/পড়লো সে রাজরোষে/মান রেখে জান দিলো শূলে-কুট-কর্মার/এই নিয়ে লেখা হলো বই এক ফর্মার।
॥ দুই ॥
কবি শামসুল ইসলাম ষাট দশকের নেতৃস্থানীয় কবি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া, অনুবাদ সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তিনি বিচরণ করেছেন। সাফল্যও পেয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। তিন দশকের পরিচয় সূত্রে আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে কবি শামসুল ইসলামের চেয়ে মানুষ শামসুল ইসলাম অনেক বড়। একজন লেখক হিসেবে তিনি তার জীবদ্দশায় প্রতিদিনই নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। কাউকে নয়- নিজেকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে প্রতিদিন কবি শামসুল ইসলাম নিজেকে অতিক্রমের চেষ্টা চালিয়েছেন।
তারপরও মনে হয়েছে কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে কবি শামসুল ইসলাম ‘পরিমাপযোগ্য’ একজন মানুষ। আমাদের চেনা-জানা জগতে তার মতো প্রতিভার হয়তো খামতি নেই। কিন্তু মানুষ শামসুল ইসলামকে আমার কাছে কবি শামসুল ইসলামের চেয়েও অনেক বড়, অনতিক্রম্য অস্তিত্ব বলে মনে হয়েছে। চারপাশের মানুষজনের প্রতি যার ভালোবাসা ছিল শতভাগ নিখাদ। বিশেষত যারা বয়সে নবীন, তাদের প্রতি তার স্নেহের পরিমাপ করা কঠিন হতো। কারও প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রাখারও চেষ্টা করতেন তিনি। খুলনায় অবস্থানকালে কবি শামসুল ইসলামের প্রিয়ভাজনদের অন্যতম ছিলেন বন্ধুবর কবি কামাল মাহমুদ। কামালের কথা উঠলেই বলতেন, ওর কবিতা আমার ভালো লাগে। ’৮৬-তে ঢাকার একটি দৈনিকে চাকরির দরখাস্তে কামাল মাহমুদ শামসুল ইসলামকে তার স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে উল্লেখ করেন।
এক সময় টুকটাক কবিতা বা ছড়া লেখার অভ্যাস থাকলেও ’৮১র পর ওই পথে আমার চলা থেমে যায়। ১৯৮৬-তে ঢাকায় সাংবাদিকতা শুরু করার পর বেশ শক্ত বাস্তবতা এবং কিছুটা অভ্যাসগত কারণে কোথাও তেমন যাওয়া হতো না। তারপরও ইসলাম ভাই প্রায় নিয়মিতই খোঁজখবর নিতেন। অফিসে এসে জানতে চাইতেন কেমন আছি। বলতেন তোর লেখা নিয়মিতই পড়ি। আমাদের এই প্রিয় কবি অধুনালুপ্ত বাংলার বাণীতে যোগ দেন রেডিও বাংলাদেশ থেকে অবসর নেওয়ার পর। সে সময় তিনি আমাকে বাংলার বাণীতে উপসম্পাদকীয় কলামে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। ইত্তেফাক কিংবা ধারেকাছে কোথাও গেলেই ছুটে যেতেন আমার হাটখোলার গণমত অফিসে। খবরপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেওয়ার পর মাঝেমধ্যেই তিনি উঁকি দিতেন, খোঁজখবর নিতেন। জানতে চাইতেন আমার বন্ধুরা কে কেমন আছেন। দেশবাংলায় ফিচার সম্পাদক পদে তার যোগদানের পর যোগাযোগটা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। খবরপত্রের ফিচার এডিটর কবি হাসান মাহমুদের টেবিলে আড্ডা জমাতেন তিনি। হাসান মাহমুদের গানেরও ভক্ত ছিলেন।
কবি-সাহিত্যিক বা বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের একটি সামাজিক দায়িত্ব থাকে। এ দায়িত্ব হলো নবীনদের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা। তাদের উৎসাহ জুগিয়ে, অনুপ্রেরণা দিয়ে প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করা। কবি শামসুল ইসলাম অকৃপণভাবে এ দায়িত্বটি পালন করেছেন। রেডিওতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় তিনি তরুণদের জোর করে ডেকে নিয়ে সুযোগ দিতেন। বিভিন্ন পত্রিকায় সাহিত্য ও ফিচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে অনুজ লেখক-লেখিকাদের তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। এমনটি করেই তিনি যেন অপার আনন্দ পেতেন। আজকের সমাজ বাস্তবতায় আমাদের মধ্যে এমন লোকের অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। কবি শামসুল ইসলাম বেঁচে থাকবেন তার কবিতা ছড়া গল্প উপন্যাসে। কিন্তু স্বজন ও গুণগ্রাহীদের মধ্যে মানুষ শামসুল ইসলাম বেঁচে থাকবেন শুধু তার কবিসত্তার জন্য নয়, হৃদয়বৃত্তির জন্যও। পরিচিতজনদের প্রতি তার অসামান্য ভালোবাসার জন্য। কবি শামসুল ইসলাম সম্পর্কে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই একজন চীনা দার্শনিকের মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘সে মানুষই বড় যিনি তার আচরণের মাধ্যমে অন্যকে বড় করে তোলেন, অন্যকে বড় বানিয়ে আনন্দ পান।’ ইসলাম ভাই তার স্বজনদের তুই সম্বোধন করতেন। আপনি তুমি বর্জন করে চলতেন সচেতনভাবে। কিন্তু যাদের তিনি তুই বলে সম্বোধন করতেন তাদের দেখতেন বড় চোখে। তাদের সাফল্যকে তিনি নিজের সাফল্য বলে ভাবতেন। বড় হতে তাদের উৎসাহিত করতেন নানাভাবে। এখানেই ছিল মানুষ শামসুল ইসলামের আসল পরিচয়।