এ বাড়ির যিনি সবার বড় তার নাম সাফিয়া বেগম। বাড়িটা তার নামে। রুবিনা এ বাড়ির আশ্রিতা। সাফিয়া বেগমের বোনের মেয়ে। সবচেয়ে সুন্দরী বোনটার সবচেয়ে গরিব ঘরে বিয়ে হয়েছে। থাকেন গ্রামে, সংগতি নেই মোটেও। খালা অবশ্য এ জন্য বোনকেই দায়ী করেন। বলেন,
: ওর কত কত ভালো ভালো ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল জানিস। কিন্তু তোর মা ওই তোর বাবাকেই বিয়ে করল! কী না খুব ভালো গান করে। আরে গান দিয়ে কি আর পেটের ভাত হয়?
খালা অবশ্য বোনঝির সামনে পালিয়ে বিয়ে করার অংশটুকু চেপে গেলেন। কিন্তু খালা চেপে গেলেও এটা জানে রুবিনা। নানি যতদিন বেঁচে ছিলেন মাঝে মাঝেই দুঃখ করে বলতেন। রুবিনার অবশ্য বাবা-মা দরিদ্র বলে কোনো আফসোস নেই। বাবাকে তার ভীষণ পছন্দ। আর বাবার বাঁশি! আহা ঘুম এসে যায়! রুবিনার ধারণা একটু সুযোগ পেলে বাবা অনেক বড় বংশীবাদক হতেন।
রুবিনাকে নিয়ে এসেছে খালা। ও গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার পর মাকে ফোন করে বললেন,
: রুবিনাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দে। এখানে পড়বে ভালো কলেজে।
এখানে ও আসাতে খালার মুখ যতটা উজ্জ্বল হলো খালাতো ভাবির মুখ ততটাই আঁধারে ঢেকে গেল! ভাইবোনদের মুখ অবশ্য একই রকম থাকল। কে এলো আর কে গেল তাতে ওদের খুব একটা যায় আসে না।
বাড়িটা খালার। কিন্তু সংসার খরচ চলে খালাতো ভাই আসিফের বেতন আর খালুজানের পেনশনের টাকায়। ভালোই চলে। তবু বাড়তি একজন লোক। ভাবির মন খারাপ হওয়ারই কথা।
ভাই ভাবি ছাড়া আছে দুই বোন। একজন ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে। কীসব কোর্স করছে। আর এক বোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। দুই বোন দুই রকম। বড় আপা চম্পা একেবারেই এলোমেলো। লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত সারাক্ষণ। ছোট আপা শম্পা সারাক্ষণ মেতে আছে সাজসজ্জা আর কীসব বেড়ানো টেড়ানো নিয়ে। খালু মারা গেছেন অনেক দিন।
খালা সাফিয়া বেগম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন আর তসবিহ টেপেন। দিন-রাত যখনই সময় পান তসবি গুনতেই থাকেন। রুবিনা মাঝে মাঝে খালার পাশে এসে বসে। খালা অবশ্য ওর সঙ্গে কথা বলার সময় কমই পান। ব্যস্ত থাকেন তসবি নিয়ে। তবে কলেজে যাওয়ার সময় ভাড়াটা, টিফিনের পয়সাটা ঠিকই ওর হাতে দিয়ে দেন। এ বাড়িতে গাড়ি আছে। গাড়িতে চড়ার সুযোগ রুবিনার হয় না। যদি কখনো খালা কোথাও যান সে সঙ্গে যেতে পারে। সেও বছরে দু-একবার।
রুবিনার খুব বাবা-মায়ের জন্য মন কেমন করছিল। সামনে কয়েকটা দিন ছুটিও আছে। ও চায় বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসতে। কথাটা বলার জন্য খালার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু খালা তসবি গুনেই চলেছেন। খালার পাশে বসে থাকে রুবিনা। এক সময় তসবিহ গোনা নিশ্চয়ই থামবে। তখন বলবে।
সত্যিই খালা এক সময় থামেন। রুবিনাকে পাশে বসে থাকতে দেখে বলেন,
: কিরে কিছু বলবি?
: হ্যাঁ খালা। সামনে ছুটি আছে। বাড়ি যেতে চাই।
: যাবি? আচ্ছা যা। তুই গেলে অবশ্য আমার খারাপ লাগবে। বেশি দিন থাকিস না। বাসে তুলে দিলে যেতে পারবি? আসার দিন ফোন করবি। বাস থেকে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করব।
: কিচ্ছু লাগবে না খালা। আমি নিজেই চলে আসতে পারব।
: আর কিছু বলবি?
বলতে বলতে তসবি হাতে তোলেন খালা,
রুবিনা আচমকা বলে ওঠে,
: আচ্ছা খালা তুমি সারা দিন তসবি গোন। কী চাও বলত?
: আর কী চাইব, চাই খোকার যেন চাকরিতে উন্নতি হয়, চম্পার যেন ভালো চাকরি হয়, শম্পার যেন ভালো বিয়ে হয় এসব।
: নিজের জন্য কিছু চাও না?
: নিজের জন্য কী চাইব?
: এই যে তোমার এত অসুখ-বিসুখ। এসব যেন সারে, তুমি যেন ভালো থাকো এসব।
: আরে আমার জন্য আমি চাইব কেন? ওরাই তো আছে।
খালার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সন্তান গর্বে সে উজ্জ্বলতা। রুবিনা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এক সময় তার একটু খালাপও লাগে। খালা সবার কথা বললেন, তার কথাও তো বলতে পারতেন। তার জন্যও তো কিছু চাইতে পারতেন। সেও তো তার বোনের মেয়ে। তার চোখের কোণে পানি জমে।
২
আট বছর পরের কথা। রুবিনা এখন পুরোদস্তুর ডাক্তার। ইন্টার্ন শেষ করেছে। পিজিতে কাজ করছে সে। সঙ্গে আরও সব কোর্স। বাবা-মা তাকে নিয়ে খুব খুশি। খুশি সাফিয়া খালাও। খালার প্রতি রুবিনার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খালা না থাকলে সে ডাক্তার হতে পারত না!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খালা আরও বৃদ্ধ হয়েছেন। রোগ শোক বেড়েছে। এ বাড়িতে এখন আছে খালা, রুবিনা, কাজের মেয়ে, দারোয়ান। খালা এখনো তসবি গোনেন। তবে গুনতে গুনতে মাঝে মাঝে থমকে যান।
রুবিনা খেয়াল করেছিল ভাই-ভাবির মধ্যে গোপনে কী যেন চলছে। কীসব যেন লেখালিখি আর গোছগাছ। ওর সন্দেহ ছিল কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু সন্দেহ সত্যি হলো। একদিন আচমকা আসিফ ভাই আর ভাবি খালাকে জানালেন, আমেরিকা চলে যাচ্ছেন। আমেরিকাতে একটা বড় সুযোগ পেয়েছেন ভাই। খালা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন। সামলাতে সময় লাগল। অনেক পরে আস্তে আস্তে বললেন,
: হঠাৎ করে এত বড় সুযোগ পেলি কী করে খোকা?
: হঠাৎ করে কী আর হয়, অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছিলাম।
: আমাকে কিছু বলিসনি তো!
: তোমাকে বলে কী হবে, তুমি কী বুঝবে এসবের!
খোকা চলে গেল! একবারও ভাবল না খালার কী হবে! বোন দুটোর কী হবে! কিন্তু ভাইয়ার চলে যাওয়া খানিকটা শক্ত করে দিল খালাকে। তসবি তিনি গোনেন যেন গোনার জন্যই। এরপর একে একে বিয়ে করে নিলো চম্পা আর শম্পা আপা। চম্পার আগেই বিয়ে করল শম্পা নিজের পছন্দে। সে ছেলেকে খালার একটুও পছন্দ হলো না। কিন্তু শম্পার তাতে কী যায় আসে! খালা দুর্বল কণ্ঠে বলেছিলেন,
: কয়েকটা দিন দেরি কর। চম্পার বিয়েটা হোক।
: ওসব সেকেলে ধারণা।
খালার কথা উড়িয়ে দিয়ে বিয়ে করে ফেলল চম্পা আপা। এর কিছুদিন পর চম্পা আপা খালাকে বলল, সে একজন ডাক্তারকে বিয়ে করতে চায়। চম্পা তবু বলল। দুই মেয়ের কারও বিয়েতেই উৎসব করতে পারল না খালা। অথচ খালার ইচ্ছে ছিল খুব হইচই করে বাচ্চাদের বিয়ে দেবেন। শম্পা চলে গেছে অস্ট্রেলিয়া। মাসে-দুমাসে একবার ভিডিও কলে খালাকে নিজের বাড়িঘর ও সুইমিংপুলের ছবি দেখায়। শম্পার একটা ছেলে হয়েছে। খালার বড় ইচ্ছে একবার নাতিটাকে স্পর্শ করার। হয় না। চম্পা আপা এই শহরেই আছেন। মায়ের কথা মনে পড়ে হয়তো কখনো কখনো। আসে কম। প্রাকটিস নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অন্য রোগী দেখতে দেখতে নিজের মায়ের অসুখ-বিসুখের কথা মনে থাকে না!
সাফিয়া খালার হাতে এখনো তসবি। ওই তসবি গোনা দেখলে মেজাজ খারাপ হয় রুবিনার। কী হলো এত তসবি গুনে। একটা ছেলেমেয়ে কী তার কথা ভাবল!
সেদিন খালাকে আবারও একই কথা বলল রুবিনা,
: এত যে সারাটা জীবন তসবি গুনলে কেউ তোমাকে দেখল, তোমার খবর নিল?
: আমার জন্য তো গুনিনি। গুনেছি ওদের জন্য। ওরা ভালো থাকুক এটাই চেয়েছিলাম। গলাটা ধরে আসে!
: তা এখন কার জন্য গোনো?
: বলতেই হবে?
: অসুবিধা না থাকলে বলো?
: এখনো গুনি ওদের ভালোর জন্য।
: বলছ কী? অবিশ্বাস্য! এত কিছুর পরও?
: হ্যাঁ, ওরা আমার সন্তান।
: তাহলে তোমার জীবনে আমার কোনো জায়গা নেই? আমার জন্য তোমার কোনো প্রার্থনা নেই?
এবার আর নিজেকে ধরে রাখত পারল না রুবিনা। ঝপ করে ঝেড়ে ফেলল এতদিন ধরে পুষে রাখা ক্ষোভটা।
: আছে। ওদের ভালো চাই, তারপর তোর।
: তাহলে আমার জায়গা বুঝি তোমার ছেলেমেয়ের পরে?
: অভিমান করিস না, সেটাই তো হওয়ার কথা, তাই না?
: তুমি সত্যি বললে, তবে জেনে রাখ, তুমি আমার জন্য তসবি গুনলেও আমি তোমার পাশে থাকব, না গুনলেও থাকব।
: ভুল বললি, তুই আমার পাশে থাকবি সে জন্য আমি তসবি গুনি না। তুই আরও বড় ডাক্তার হবি, মানুষের পাশে দাঁড়াবি, সে জন্য।
রুবিনা কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। খালা তসবি গুনে তার ভালো চাক বা না চাক, খালার চেয়ে তার ভালো এ দুনিয়ায় কেউ চায়নি। তাই সে ডাক্তার হয়েছে। আজ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে। রুবিনার ইচ্ছে হয় খালাকে জড়িয়ে ধরতে। ধরে না, কেমন যেন লজ্জা করে। কিন্তু ও জানে খালাকে জড়িয়েই আছে। থাকবে।