পৃথিবীতে ফিরে এসেছে বোয়িংয়ের তৈরি মহাকাশযান স্টারলাইনার। তবে নাসার নভোচারী বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামসকে সেখানে রেখে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) থেকে ছয় ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে ক্যাপসুলটি পৃথিবীতে পৌঁছে। শনিবার স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১ মিনিটে নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস স্পেস হারবারে অবতরণ করে এটি।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা স্টারলাইনার মহাকাশযানের অবতরণের ভিডিও লাইভ সম্প্রচার করে। এতে দেখা যায়, মহাকাশযানটি সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় যানটি ঘণ্টায় ২৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবীর দিকে আসছিল। সেই সময় যানটির হিট শিল্ড সক্রিয় করা হয়, যাতে তাপ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। অবতরণের প্রায় ৪৫ মিনিট আগে একে একে ৩টি প্যারাশুট খোলা হয়, যা মহাকাশযানটিকে নিরাপদে মাটিতে নামতে সহায়তা করে।
উল্লেখ্য, এ বছরের জুনে বোয়িং নির্মিত স্টারলাইন রকেটে করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাড়ি জমান নাসার দুই নভোচারী বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস।
স্টারলাইনারে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেওয়ায়, তারা এখন স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন মহাকাশযানে করে ফেরার অপেক্ষায় আছেন, তবে সেটা ফেব্রুয়ারির আগে সম্ভব হচ্ছে না। এক সপ্তাহ পরই ফিরে আসার কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে এখন তাদের মিশন সময়কাল আট মাসে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স্টারলাইনারের অবতরণের পর নাসার একজন মুখপাত্র বলেন, সফল অবতরণে খুশি হলেও, পরিকল্পনা মোতাবেক মিশন শেষ না হওয়ায় কিছুটা হতাশ তারা।
স্টারলাইনারের অবতরণের আগে নাসা জানিয়েছিল, বুচ উইলমোর এবং সুনি উইলিয়ামস ভালো অবস্থায় রয়েছেন এবং তারা নিয়মিতভাবে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নাসার বাণিজ্যিক ক্রু প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক স্টিভ স্টিচ বলেন, “মহাকাশচারীরা তাদের কাজের প্রতি উদ্দীপ্ত এবং তারা মিশনের অবশিষ্ট অংশ সফলভাবে সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।”
মহাকাশচারীদের নিয়ে এটি বোয়িংয়ের স্টারলাইনারের প্রথম উড্ডয়ন ছিল। গত ৫ জুন ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে উৎক্ষেপণের পরপরই এটি প্রযুক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়। নতুন এই রকেটে প্রপালশন সমস্যা ও হিলিয়াম লিক হওয়ার কথা জানিয়েছে বোয়িং।
উৎক্ষেপণের একদিন পরই ক্যাপসুলটি স্পেস স্টেশনের কাছাকাছি যাওয়ার সময় ক্যাপসুলে থাকা হিলিয়াম লিকেজের কারণে ইঞ্জিনে জ্বালানি প্রবাহে জটিলতা দেখা দেয় এবং এর পাঁচটি থ্রাস্টার নষ্ট হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে চারটি থ্রাস্টার আবার সক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে।
বোয়িং এবং নাসার প্রকৌশলীরা কয়েক মাস ধরে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা চালালেও, শেষ পর্যন্ত আগস্টের শেষ দিকে নাসা ঘোষণা করে যে স্টারলাইনার মহাকাশচারীদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নিরাপদ নয়। স্টারলাইনারে মহাকাশচারীদের নিয়ে আসার ব্যাপারে নাসা এবং বোয়িংয়ের মধ্যে আলোচনা চলাকালে উভয়পক্ষের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ দেখা দেয়। বোয়িং দাবি করে যে, তাদের মহাকাশযান নিরাপদে মহাকাশচারীদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম, কিন্তু নাসা বিষয়টি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
নাসার ব্রিফিংয়ে বোয়িংয়ের প্রতিনিধিরা অনুপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নাসার কর্মকর্তা জোয়েল মোন্টালবানো বলেন- বোয়িং নাসাকে মিশন উপস্থাপনের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। তবে বোয়িং পরে একটি বিবৃতি দিয়ে জানায়- স্টারলাইনার টিম সফলভাবে মহাকাশযানের বিচ্ছিন্নকরণ, পুনঃপ্রবেশ এবং অবতরণে কাজ করেছে এবং তারা এখন মিশনের তথ্য পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে।
স্পেসএক্সের পরবর্তী মহাকাশযান ‘ক্রু ড্রাগন’ সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে উৎক্ষেপণ করা হবে, যেখানে চারজন মহাকাশচারীর থাকার কথা ছিল। তবে বর্তমানে দুটি আসন খালি রাখা হয়েছে, যাতে বুচ উইলমোর ও সুনি উইলিয়ামস তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পৃথিবীতে ফিরতে পারেন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ব্যবস্থাপক ডানা ওয়েইগেল জানিয়েছেন, বুচ এবং সুনি তাদের মিশনের বর্ধিত সময়ের সঙ্গে ভালোভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন। তারা এর আগেও দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ মিশন সম্পন্ন করেছেন, তাই এই নতুন পরিস্থিতিতে তাদের জন্য মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছে।
তিনি আরও জানান, তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে তারা শরীরকে ওজনশূন্য অবস্থায় সুস্থ রাখার চেষ্টা করছেন।
স্টারলাইনার মহাকাশযানের প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলো বোয়িংয়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোম্পানিটি আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বেশ কিছু উড়োজাহাজের দুর্ঘটনার কারণে খারাপ সময় পার করছে। তবে সমস্যাগুলো সত্ত্বেও নাসা বোয়িংকে সমর্থন করে যাচ্ছে এবং তাদের মহাকাশযানকে পুনরায় কার্যকর করার জন্য কাজ করছে।
২০১১ সালে নাসার স্পেস শাটল বহর অবসর নেওয়ার পর থেকে আমেরিকা এক দশক ধরে রাশিয়ার সয়ুজ মহাকাশযানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এই নির্ভরশীলতা কমাতে ২০১৪ সালে নাসা বোয়িং এবং স্পেসএক্সকে মহাকাশযান তৈরির জন্য চুক্তি দেয়। বোয়িংয়ের চুক্তির মূল্য ছিল ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার এবং স্পেসএক্সের ছিল ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
এখন পর্যন্ত স্পেসএক্স নাসার জন্য নয়টি সফল মিশন পরিচালনা করেছে। তবে এটি ছিল মহাকাশচারী নিয়ে বোয়িংয়ের প্রথম পরীক্ষামূলক মিশন। সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/একেএ