যুগে যুগে মহান আল্লাহ পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচারে প্রেরণ করেছেন অসংখ্য বুজুর্গ ব্যক্তি। যাঁরা পরবর্তীকালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছেন ইসলামের আলো। এসব মহান সুফি-সাধকের হাত ধরে অগণিত পথহারা মানুষ পেয়েছেন দীন ইসলামের আলো। দীনি শিক্ষা গ্রহণ এবং সাধনা করে তারা পরিণত হয়েছেন এসব মনীষীর ভক্ত-আশেকানে। আর সেই অনুসারীরাই তাঁদের বুজুর্গদের প্রতি ভালোবাসা এবং স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে সমবেত হন অলি-আউলিয়াদের মাজারে...
হজরত ওয়াইস করনি (রহ.)
ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, ওয়াইস করনি সিফফিনের যুদ্ধে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর পক্ষে লড়াই করে মারা যান। সিরিয়ার রাক্কাহতে তাঁর মাজার ছিল। এ ছাড়াও সারা বিশ্বে আল্লাহর এ অলির মাজার রয়েছে আরও ছয়টি। সব মিলিয়ে বিশ্বে ওয়াইস করনির সাতটি মাজার রয়েছে
খুব ছোট নাম। তবে মুসলিম জাহানের কাছে সর্বাধিক পরিচিত মুসিলম অলি। মুসলিম মনীষীদের মধ্যে যারা পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচারে জীবন উৎসর্গ করেছেন হজরত ওয়াইস করনি (রহ.) তাঁদের অন্যতম। তিনি ইয়েমেনের একজন সুফি, শহীদ ও দার্শনিক। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় তিনি জীবিত ছিলেন। কিন্তু কখনোই তাদের দেখা হয়নি। ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, ওয়াইস করনি সিফফিনের যুদ্ধে আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর পক্ষে লড়াই করে মারা যান। সিরিয়ার রাক্কাহতে তাঁর মাজার ছিল। এ ছাড়াও সারা বিশ্বে আল্লাহর এ অলির মাজার রয়েছে আরও ছয়টি। সব মিলিয়ে বিশ্বে ওয়াইস করনির সাতটি মাজার রয়েছে। সিফফিন, আজারবাইজান, ইয়েমেন, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ, মদিনা শরিফের দক্ষিণে জোবায়দায়, আফগানিস্তানের গজনি এবং ইরাকের বাগদাদে মহান এ মনীষীর মাজার শরিফ অবস্থিত। ওয়াইস করনি একদিন আল্লাহপাকের কাছে এই বলে প্রার্থনা করেন যে, হে আল্লাহ আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতে গোপন রাখ। কেউ যেন আমার সঠিক পরিচয় জানতে না পারে। আল্লাহপাক তাঁর দোয়া কবুল করেন। এ দোয়া করার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহর কুদরতে একজন ওয়াইস করনি থেকে সাতজন সৃষ্টি হয়ে সাত দেশে চলে যান। পরবর্তীতে এ সাতজন সাতভাবে সাত জায়গায় ইন্তেকাল করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ সাতটি মাজারেই অলৌকিক কেরামত লক্ষিত হয়। ওয়াইস করনি (রহ.)-এর মাজার সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আজও রহস্য। চিরকাল থাকবে বলে ধারণা করা হয়। তাঁর পুরো নাম সুলতানুল আশেকে রব্বানি হজরত ওয়াইস করনি (রহ.)। তিনি ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইয়েমেনের করন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জাতিসত্তায় তিনি ছিলেন আরবি। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম বেদউরা। তাঁর পদবি ছিল সুলতানুল আশেকিনে রব্বানি, আল্লাহ ও রসুলের নয়নমণি। সুন্নি, সুফি ও শিয়াদের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। আলী ইবনে আবু তালিব (রহ.)-এর পক্ষে লড়াই করে ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে ওয়াইস করনি সিফফিনের যুদ্ধে শহীদ হন। তারপর তাঁকে সিরিয়ার রাক্কাহতে দাফন করা হয়। এক সময় কিছু চরমপন্থি গোষ্ঠী এটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তাঁর সম্মানে তুরস্কের সির্ত প্রদেশের বায়কানে এক মাজার নির্মাণ করা হয়। আধ্যাত্মিক সাধনায় তিনি এতই মশগুল থাকতেন যে, নিজের দেহের প্রতি কোনো খেয়ালই করতেন না। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ফরসা মধ্যম আকৃতির, চোখ দুটি ছিল নীল সমুদ্রের মতো, মাথার চুল ছিল আলু-থালু, উসকো-খুসকো। তিনি এতই ইবাদতে মশগুল থাকতেন যে, খাওয়া, ঘুম ভুলে যেতেন। কঠোর ইবাদতের ফলে তাঁর পেট পিঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল, সারা শরীর ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সারা দেহে মাংস বলতে কিছুই ছিল না, ছিল শুধু হাড়। দূর থেকে তাঁর দেহের সব হাড় গোনা যেত। তিনি তালি দেওয়া কাপড় পরতেন। সাধারণ মানুষ দেখে তাঁকে রাস্তার পাগল বলে উপহাস করত।
হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)
মুসলিম জাহানে তিনি বড়পীর হিসেবে পরিচিত। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এখনো যাকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করেন তিনি বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। আর তাঁকে নিয়ে অনেক কথা। আজও মুসলমানরা গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তাঁকে স্মরণ করেন। হিজরি পঞ্চম শতকে মুসলিম জাহান চরম দুর্বিপাকে পড়ে। কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় খিলাফতের মধ্যে গড়ে ওঠে বহু স্বাধীন রাজ্য। এর মধ্যে একদিকে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে চলতে থাকে খ্রিস্টান শক্তি কর্তৃক বহিরাক্রমণ। এ নাজুক রাজনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ও নেমে এসেছিল চরমভাবে। জাতির এ চরম দুর্দিনে ইসলামের আঁধার আকাশে উদিত হয়েছিল এক রওশন আফতাব, যাঁর বিমল জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল দিগদিগন্ত। তিনি হচ্ছেন বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের এ মনীষী হিজরি ৫৬১ সনে পরলোকগমন করেন। খ্রিস্ট সাল অনুযায়ী তখন ছিল ১১৬৬ সাল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী ‘ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম’ নামে পরিচিত। ফাতেহা অর্থ দোয়া, আর ইয়াজদহম অর্থ এগারো। রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখ হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর স্মরণে বিশ্বব্যাপী তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা দোয়া মাহফিলের মাধ্যমে পালন করে থাকেন। ইরাকের বাগদাদ শহরের ‘বাবুশ শায়েখ’ এলাকায় তাঁর মাজার অবস্থিত। এ দিনে ভক্তদের উদ্যোগে ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম উপলক্ষে মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়। মাহফিল-মজলিসের আয়োজন করা হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ শরিফ ও সালাম, কালেমা পাঠ, জিকির-আজকার ও ইসালে সওয়াব ইত্যাদি পালন করা হয়। একে এগারোই শরিফ বা গিয়ারভি শরিফ বলে। দিবসটি গাউসে পাকের উরস মোবারক। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। ৪৭০ বা ৪৭১ হিজরির ১ রমজান পারস্যের এক বিখ্যাত জনপদ ‘জিলানে’ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের অন্যতম প্রচারক হওয়ায় তাঁকে ‘গাউস উল আজম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলাম ধর্মমতে তাঁকে ‘বড়পীর’ হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) নামে অভিহিত করা হয়। শিক্ষাদীক্ষায় পূর্ণতা অর্জনের পর তিনি নিজেকে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত করেন। তাঁর মাহফিলে শুধু মুসলিম নয়, অনেক অমুসলিমও অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর বক্তব্য শুনে তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন। তিনি কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর রচিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থের মধ্যে ফতহুল গায়র, গুনিয়াতুত তালেবিন, ফতহুর রব্বানি, কাসিদায়ে গাওসিয়া উল্লেখযোগ্য। জ্ঞান-গরিমায় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহর অলির স্থান আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে সবার ঊর্ধ্বে।
হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.)
মৃত্যুর দিন ভোরবেলায় তিনি ফজর নামাজ আদায় করেন এবং নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করে শুয়ে পড়েন। ইমাম গাজ্জালির আবির্ভাব ঘটে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে, যখন পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শন বিস্তার লাভ করেছে
‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ইসলামের প্রামাণ্য অবয়ব হজরত ইমাম গাজ্জালি (রহ.)কে এ নামে ডাকা হতো। তাঁর অগাধ জ্ঞান এবং প্রভাবশালী দর্শন সমসাময়িক নয়টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। মহান এ ব্যক্তি ৫০৫ হিজরি, ১১১১ সালে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। ইরানের অমর কবি ফেরদৌসীর সমাধির পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর দিন ভোরবেলায় তিনি ফজর নামাজ আদায় করেন এবং নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করে শুয়ে পড়েন। ইমাম গাজ্জালির আবির্ভাব ঘটে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে, যখন পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শন বিস্তার লাভ করেছে। তিনি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য দেখান এবং ধর্মকে দর্শনের ওপর প্রাধান্য দেন। গাজ্জালির একমাত্র বিশ্বাস ও অবস্থান ছিল ওহি বা নবুয়তি চিন্তাধারা মানুষের সব আকল বা বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। তাঁর মতে, দূরকল্পী কোনো যুক্তির সাহায্যে কোনো দার্শনিক মতবাদ প্রমাণ করা যায় না। জনসাধারণের ধর্ম বিশ্বাসকে যুক্তিবিজ্ঞানের সাহায্যে বিন্যস্ত কতগুলো আকাইদ সূত্রে পরিণত করার প্রবণতাকে প্রকাশ্যভাবে নিন্দা করেন। ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪৫০ হিজরি সনে হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামেদ মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি। গাজল অর্থ সুতা, নামকরণের এ সামঞ্জস্যতা তাই তাঁর বংশকে গাজ্জালি নামে পরিচিত করেছে। কারও মতে, ইমাম গাজ্জালির বংশের লোকেরা সম্ভবত সুতার ব্যবসা করতেন। তাই তাদের বংশ উপাধি গাজ্জালি নামে পরিচিত। অনেক বিশেষজ্ঞ ও দার্শনিকের মতো গাজ্জালিও বিশ্বকে অস্থায়ী ও চিরন্তন- এ দুইভাবে দেখেছেন। এ বিশ্ব বা ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্ব সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত- এটি কোনো আইন বা সরকার কর্তৃক পরিচালিত নয়। তাঁর মতে, তিনি কেবল বিশ্বই সৃষ্টি করেননি বরং বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ বিষয়েরও স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক। গাজ্জালি তাঁর বিরোধীদের উদ্দেশ করে ইসলামী আইন ও সুফিতত্ত্বের ওপর প্রায় ৪০০ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তাঁর রচিত বড় দুটি গ্রন্থ হচ্ছে- এহয়াহিউল উলুম ও কিমিয়ায়ে সায়াদাত। এহয়াহিউল উলুম তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও চিন্তাধারাকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)
বিশ্ববিখ্যাত অলি খাজা মঈনুদ্দীন হাসান চিশতি আজমেরি সাঞ্জেরি (রহ.) এক পরিচিত নাম। তিনি একজন ইসলাম প্রচারক। তাঁর মাধ্যমে প্রায় এক কোটি বিধর্মী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি জীবনভর পথহারা মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করে গেছেন। খ্রিস্ট ১২৩৬ সাল বা ৬৩৩ হিজরিতে সূর্যোদয়ের সময় মহান এ ব্যক্তি পরলোকগমন করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। মুসলিম জাহানের এ অলির মাজার শরিফ ভারতের আজমিরে অবস্থিত। এ উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি আসার আগে এখানকার মানুষ চরম অন্ধকারে বসবাস করছিল। কথিত আছে, মদিনা শরিফে নবী করিম (সা.) তাঁকে স্বপ্নযোগে হুকুম করেন ভারতের আজমির নামক স্থানে ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য। তারপর তিনি আজমিরের উদ্দেশে রওনা হন। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) আজমিরে আসার আগে হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজের দাপটে জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.)-এর আজমিরে আগমন ঘটে। এ মহান বুুজুর্গের আগমনে রাজা পৃথ্বীরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) আজমিরে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা করেন। শক্তিশালী ও অত্যাচারী রাজা পৃথ্বীরাজ তার বিশাল সৈন্যবাহিনী, তান্ত্রিক সাধক এবং আরও অন্যান্য শক্তি প্রয়োগ করেও খাজা গরিবে নেওয়াজের কোনো ক্ষতি করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত খাজাবাবা সব দুষ্ট শক্তিকে দমন করে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। আল্লাহর এ অলির বয়ান ও আচরণে মানুষ সহজেই তাঁর প্রতি মোহিত হয়ে যেত। তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন আধ্যাত্মিক সাধক। ছোটবেলা থেকেই তিনি কঠোর ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) ৫৩৬ হিজরিতে বা ১১৪১ সালে পূর্ব পারস্যের সিসটান রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জ্ঞানার্জন ও উচ্চশিক্ষার জন্য বোখারার উদ্দেশে যাত্রা করেন। তখন থেকেই তাঁর বিশ্বভ্রমণ শুরু। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) দুনিয়ার সব আকর্ষণ ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত থাকতেন।
হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)
দিল্লির শেখ খাজা সৈয়দ মোহাম্মদ নিজামুদ্দীন আউলিয়া হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। সুলতান-উল-মাশায়েখ, মাহবুব-এ-ইলাহি, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দীন আউলিয়া হজরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) নামেও পরিচিত। নিজামুদ্দীন আউলিয়া ১৩২৫ সালের ৩ এপ্রিল সকালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মাজার ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত। বর্তমানে যে স্থাপনাটি তাঁর মাজার হিসেবে পরিচিত সেটি ১৫৬২ সালে নির্মিত হয়। ভারতে চিশতিয়া তরিকার সুফি সাধকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। হিজরি ৬৩৪ মতান্তরে ৬৩৬ সনের ২৭ সফর বদায়ুনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর পূর্ব পুরুষরা সাদাত বংশের লোক ছিলেন। হিজরি ষষ্ঠ শতকে তাতারি হামলাকারীরা এশিয়া মাইনরের বালখ, বোখারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছিল। সেখান থেকে অসংখ্য খান্দান ভারতে চলে আসে। সেখানে তখন শামসুদ্দীন আলতামাশ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু এ সুলতানের সুখ্যাতি ছিল ব্যাপক। পাঁচ বছর বয়সে তিনি দিল্লি আসেন। অনেকেই দাবি করেন, মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি হজরত ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকরের নাম স্মরণ করতে থাকেন। ২০ বছর বয়সে পাকিস্তানের পাকপাত্তান চলে যান এবং সুফি ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকরের বাইয়াত গ্রহণ করেন। তিনবার রমজান মাসে বাবা ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকরের দরবারে অবস্থান করেন। এখান থেকেই তিনি সুফিবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন। চিশতিয়া তরিকার একজন সাধক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। হজরত ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকরের প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন ধীরে ধীরে। নিজামুদ্দীন আউলিয়া, তাঁর পূর্বসূরিদের মতো প্রেম বা ইশককে স্রষ্টা বা আল্লাহ প্রাপ্তির পন্থা বা পথ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়। ধনী-গরিবসহ সব শ্রেণির মানুষ তাঁর মাজার জিয়ারতে আসেন। তাঁর প্রয়াণ দিবসে এখানে লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। তাঁর অনেক শিষ্য আধ্যাত্মিকতার উচ্চ আসন অর্জন করেছেন। তাঁর গুরু ফরিদউদ্দীন গঞ্জেশকর। যাঁর মূল কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকি হয়ে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির সঙ্গে মিলিত হয়। এই অনুযায়ী তাঁরা চিশতিয়া তরিকার সিলসিলা তৈরি করেছেন।
হজরত ইমাম মুসলিম (রহ.)
হাদিসের বিশুদ্ধতা নিরূপণে ইতিহাসে যেসব মহামানব চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের অন্যতম হলেন ইমাম মুসলিম (রহ.)। তাঁর পুরো নাম আল-ইমাম আল-হাফেজ হুজ্জাতুল ইসলাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশিয়ারী আন-নায়সাবুরী। ২০৪ হিজরি সন মোতাবেক ৮২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইমাম মুসলিম (রহ.) ইলমে হাদিস শিক্ষায় মনোযোগ দেন। তিনি ২১১ জন বিশিষ্ট মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইলমে হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং হাদিস সংগ্রহ করেন। ইমাম বোখারি (রহ.) ছিলেন ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর ওস্তাদ। ২৬১ হিজরির ২৫ রজব রবিবার মোতাবেক ২৮০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত নিশাপুরে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ইমাম মুসলিম (রহ.) ১৫ বছরের সাধনায় তিন লাখ হাদিস থেকে যাচাই-বাছাই করে ‘সহিহ মুসলিম’ শরিফ সংকলন করেছেন। ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর বিশিষ্ট সাগরেদ আহমাদ ইবনে সালামা বলেন, ‘আমি মুসলিমের সঙ্গে তাঁর আসসহিহ প্রণয়নকালে ১৫ বছর লেখালেখির কাজ করেছি (তাজকিরাতুল হুফফাজ)। ইমাম মুসলিম (রহ.) শুধু সহিহ হাদিসের সমন্বয়ে এ মহান গ্রন্থখানা রচনা করেছেন। তাই এর নামকরণ করেছেন ‘আস সহিহ।’ ইমাম মুসলিম (রহ.) ইলমে হাদিসের যে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার সংগ্রহ করেছিলেন তা শিক্ষা দিয়ে যেমন অসংখ্য মুহাদ্দিস তৈরি করে গেছেন, সেই সঙ্গে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে জগৎবাসীর জন্য মহামূল্যবান উপহার হিসেবে রেখে গেছেন। সহিহ মুসলিম ছাড়াও ইমাম মুসলিম (রহ.) যেসব গ্রন্থ রচনা করে গেছেন তার মধ্যে কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো- মুসনাদে কবির, কিতাবুল জামে, কিতাবুল আসমা ওয়াল কুনা, কিতাবুৎ তাময়িয, কিতাবুল ইলাল ওয়া, কিতাবুল ওয়াহদান, কিতাবুল ইফরাদ, কিতাবুল আরকান, কিতাবু হাদিসি আমর ইবনে শুয়াইব, কিতাবু মাশায়েখে মালেক, কিতাবু মাশায়েখে শোবা, কিতাবু আওলাদিস সাহাবা, কিতাবু আওহামিল মুহাদ্দিসিন, কিতাবুত তাবাকাত, কিতাবু সুয়ালাতি আহমাদ বিন হাম্বল, কিতাবু মান লাইসা লাহু রাব্বুন ইল্লা ওয়াহিদ ইত্যাদি। মুসলিম শরিফ রচনায় তিনি কেবল নিজের স্মৃতিশক্তির ওপরই নির্ভর করেননি। গ্রন্থটি রচনার পর তৎকালীন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের সামনে পেশ করেছেন। তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন, তাদের স্বীকৃতি নিয়ে চূড়ান্ত রচনার কাজটি সমাধা করেছেন।