‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের বহুল আলোচিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই মর্মে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে যে এ বছর বাংলাদেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা গত বছরের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ এ সময়ে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। অন্যদিকে এ সময়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের সংখ্যা গত বছরের ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে ওই প্রতিবেদনে হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ এ বছর বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের তালিকায় আরও প্রায় ৫৩ লাখ নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে। এদিকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য ওঠানামার মধ্যে থাকলেও কিছুতেই তা সাধারণ সহনসীমার মধ্যে আসছে না। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এ উচ্চধারা অব্যাহত থাকলে, যা থাকার আশঙ্কাই সর্বাধিক, মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা সহসাই এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছে যেতে পারে, যা দেশে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যাই শুধু বাড়াবে না-মধ্যম আয়গোষ্ঠীর মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের অন্য সূচকগুলোকেও প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। এর মধ্যে ব্যয় কাটছাঁট করার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে ন্যূনতম পুষ্টিস্তর রক্ষার বিষয়টি। এমনি পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য পরিস্থিতির মোকাবিলায় অর্থাৎ এর অবনতি ঠেকানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দুই-ই স্থবিরতার মুখে পড়তে পারে। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে এ মর্মে প্রাক্কলন হাজির করেছে যে এ বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং তা হলে সেটি হবে গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উল্লেখ্য গত ২০ বছরের মধ্যে দেশে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনাকালে। আর এরকম একটি অবস্থায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চাপ মোকাবিলায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার আওতায় কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, সেটি অনেক বড় আলোচনা। অতএব সে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে এখানে শুধু দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি যাতে পরবর্তী বছরগুলোত আর বৃদ্ধি না পায়, তার জন্য বিভিন্ন করণীয়ের অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র, কুটির ও গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়নে কী কী করা যায়, তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
দারিদ্র্য প্রশমনে ক্ষুদ্র, কুটির ও গ্রামীণ শিল্পের উন্নয়নকে কৌশল হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোড়াতেই যে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, সেগুলো হচ্ছে : এক. শিল্পনীতিতে দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমা হচ্ছে যথাক্রমে ১৫ কোটি ও ১০ লাখ টাকা। ফলে ক্ষুদ্র শিল্পকে সাধারণভাবে যত ক্ষুদ্র ভাবা হয়, আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞায় সেটি আসলে তত ক্ষুদ্র নয়-এর চেয়ে অনেক বড়। দুই. কুটির শিল্পের একটি বড় অংশ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত হলেও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রায় সবই এখন পর্যন্ত শহর বা আধা-শহরাঞ্চলে অবস্থিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ক্ষুদ্র শিল্প এখন একইভাবে গ্রামাঞ্চলেও স্থাপন করা সম্ভব। তিন. কুটির শিল্প পৃথিবীজুড়েই মূলত ব্যক্তিগত নৈপুণ্যভিত্তিক শিল্প। ফলে এ শিল্পে কর্মসংস্থানের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং ক্ষুদ্র শিল্পেও এ হার যথেষ্ট উচ্চবর্তী। চার. শিল্পনীতির সংজ্ঞায় ‘গ্রামীণ শিল্প’ বলতে আলাদা কোনো শিল্প নেই বিধায় বিনিয়োগসীমা নির্বিশেষে গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত যে কোনো শিল্পই হচ্ছে গ্রামীণ শিল্প। এবং পাঁচ. কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেই নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কারিগর। ফলে এ শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে খুব স্বাভাবিকভাবেই একধরনের বাড়তি মমতা ও অঙ্গীকারাবদ্ধতা যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে, যেটি এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের একটি বড় শক্তি। তো, এ রকম একটি পটভূমিতে দারিদ্র্য বিমোচন ও নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পক্ষে অবদান রাখার বিপুল সুযোগ রয়েছে বলাটাই শুধু যথেষ্ট নয়। বরং বলা প্রয়োজন যে এ কাজের জন্য এরচেয়ে বেশি সুযোগ এই মুহূর্তে আর কোনো খাতেই নেই। ফলে এ খাতের বিকাশকে কীভাবে আরও ত্বরান্বিত করা যাবে এবং সেটিকে কীভাবে আরও অধিক গুণগত মানসম্পন্ন ও প্রতিযোগিতা-সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে বিষয়ে একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন উভয় পর্যায় মিলে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করাটা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। আর সে লক্ষ্যে এ ক্ষেত্রে আশু ব্যবস্থা গ্রহণার্থে কতিপয় প্রস্তাব কর্তৃপক্ষীয় বিবেচনার জন্য নিচে তুলে ধরা হলো।
এক. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) প্রভৃতি যেসব প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ে বিস্তৃততর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে, তাদের উচিত হবে গ্রামের শিক্ষিত তরুণদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের উদ্যোক্তাবৃত্তিতে উৎসাহিত করা এবং এর ধারাবাহিকতায় তাদের জন্য উদ্যোক্তা উন্নয়নসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা।
দুই. ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক তাদের শর্ত দেওয়া আছে যে তাদের বিনিয়োগযোগ্য ঋণ তহবিলের একটি ন্যূনতম অংশ কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতে বিতরণ করতে হবে এবং গ্রামাঞ্চলে শাখা বাড়াতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এ শর্ত বা নির্দেশনা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এমতাবস্থায় দেশে বিরাজমান নাজুক দারিদ্র্য পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি জরুরি ভিত্তিতে একটি তাগিদপত্র জারি করে, তাহলে সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। আর এ ব্যাপারে বিসিকের উচিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে উল্লিখিত কাজটি দ্রুত করিয়ে নেওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে চলা ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা প্রদান করা। তিন. বিসিক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিআরডিবি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের আওতায় বর্তমানে নারী উন্নয়নের জন্য যেসব কার্যক্রম ও কর্মসূচি চালু আছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে সেগুলোকে যতটা সম্ভব গ্রামমুখী করে তোলা এবং গ্রামের নারী কারুশিল্পী, কারিগর ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও প্রণোদনা দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করা।
চার. সৃজনশীল নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্প্রতি ৯০০ কোটি টাকার যে উদ্যোক্তা তহবিল (স্টার্টআপ ফান্ড) গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটির উপকার যাতে শহুরে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি গ্রামীণ উদ্যোক্তারাও পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে নতুন উদ্যোক্তা অনুসন্ধান ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেবা খাতের পরিবর্তে উৎপাদনমূলক শিল্প প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ সেখানে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের হার দুই-ই বেশি। আর এ দুটি বিষয়ে এগিয়ে থাকতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই তা দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে সহায়ক হবে। মোটকথা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যক্ষ অবদান রাখা-এ উভয় বিবেচনা থেকেই সেবা খাতের বিপরীতে উৎপাদন খাতকে এগিয়ে রাখতে হবে।
ছয়. উপরোল্লিখিত পাঁচ ধরনের বিশেষায়িত উদ্যোগের বাইরে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রমগুলোকেও এখন থেকে আরও জোরদার করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাতে নিকট ভবিষ্যতে গড়ে উঠতে যাওয়া শিল্প-কারখানাগুলো যাতে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে আপস না করেও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেদিকটির প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের যে ২০ শতাংশ বা নতুন হিসাব অনুযায়ী ২২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তাদের প্রত্যেকের জীবনে দারিদ্র্যের বয়সকাল তাদের স্ব-স্ব বয়সের সমান। অর্থাৎ তারা সবাই জন্মের প্রথম দিন থেকেই এ দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে আসছে। সেই সুবাদে দারিদ্র্য তাদের কাছে একটি অতিপরিচিত বিষয়। ফলে বিষয়টি কষ্টের হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের অভ্যস্ততা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ বছর নতুন করে যে ৫৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে, তারা কেউই -ইতোপূর্বেকার কষ্টকর জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিল না। ফলে বিষয়টি তাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করার পাশাপাশি তা বড় ধরনের নতুন সামাজিক অসন্তুষ্টিরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমতাবস্থায় দারিদ্র্যবিমোচনের বৃহত্তর স্বার্থে এবং শেষোক্ত সামাজিক অসন্তুষ্টির ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে দেশে এই মুহূর্তে উৎপাদন বৃদ্ধি ও নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণের কোনোই বিকল্প নেই এবং সে ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, কুটির ও গ্রামীণ শিল্পই হচ্ছে উত্তমতম বিকল্প।
লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিল্প মন্ত্রণালয়