কওমি মাদরাসা ভারত উপমহাদেশে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে এক অতুলনীয় প্রতিষ্ঠান। এ উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা করার দুর্গ হিসেবে কওমি মাদরাসার আত্মপ্রকাশ। দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার কারিকুলাম অনুসারে পরিচালিত এ মাদরাসাগুলো কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়। ইসলামি জ্ঞান, নৈতিকতা বিকাশ, শিষ্টাচার চর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় কওমি মাদরাসার অবদান অসাধারণ। জাতীয় জীবনে ইমাম-খতিব, মুফতি, হাদিস ও তাফসিরবিশারদ এবং ইসলামিক স্কলার প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসার ভূমিকা অপরিসীম। কওমি মাদরাসার অবদান পৃথিবীর মানুষ কোনো দিন ভুলতে পারবে না। এর প্রতিদান মানুষ কখনো দিতে পারবে না। এ মাদরাসাগুলো যদি না থাকত, ভারতবর্ষে দীন-ধর্মের চেতনা খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল। কওমি মাদরাসার ওলামায়ে কেরাম, ছাত্রবৃন্দ এবং কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে পরিচালনা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং পড়াশোনা উন্নয়নের জন্য যে শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করেন, গোটা পৃথিবীতে এর কোনো উদাহরণ নেই। সমস্ত ত্যাগ ও সাধনার একটাই লক্ষ্য আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এবং রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে পৃথিবীর বুকে জাগ্রত রাখা। জাগতিক কোনো আশাভরসা জগৎবাসীর কাছে তাদের নেই। জনগণকে ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ইসলামি শিক্ষা ও ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করাই তাদের কাজ। অত্যন্ত দুঃখ ও উদ্বেগের বিষয়, বর্তমানে পৃথিবীর অবস্থা দিনদিন পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের মনমানসিকতা বদলে যাচ্ছে, ধার্মিকতা লোপ পাচ্ছে। যে কারণে মাদরাসার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা কমে যাচ্ছে। আলেম-ওলামাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও সম্মান হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান ধর্মীয় পরিবেশ আর অতীতের অবস্থা ভিন্ন। তাই কওমি মাদরাসায় দান ও সহযোগিতার সরল মানসিকতা অনেকের মধ্যে নেই। ফলে ওলামায়ে কেরাম মানুষদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে, তবে সীমিত জ্ঞানের লোকজন বিষয়টাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে এবং আপত্তিকরভাবে প্রচার করে। এসব বিষয় অনুধাবন করে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করা এ যুগের চ্যালেঞ্জ। এ পরিসরে কয়েকটি প্রস্তাব-
এক. মানুষের দুয়ারে, হাটেবাজারে ধরনা দিয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা গাড়ি থামিয়ে কালেকশন করার পদ্ধতি পরিবর্তন করা সময়ের বিবেচনাধীন বিষয়। এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া ওঠানোর ক্ষেত্রে ভিক্ষুকদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, আলেমদের সঙ্গেও ওই ব্যবহারই করা হয়েছে। চামড়া নিয়ে দৌড়ঝাঁপ, লবণ দেওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কিছু স্থানে ছাত্রদের পশুর চামড়া ছিলে নিতে হয়েছে। অথচ চামড়ার মূল্য ছিল অতি নগণ্য। একটা গরুর গোশত কাটার মূল্য ৫ হাজার টাকা এবং ছাত্ররা পশু জবাই ও চামড়া ছিলার বিনিময়ে পেয়েছে মাত্র একটা চামড়া। যে চামড়া অনেক স্থানে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা ছাড়া বিকল্প ছিল না। এ ছাড়া ঈদ সবার জন্য। সবার জন্য আনন্দের দিন। স্বাধীন ও মুক্ত দিবস। সব পেশার লোক এদিনে ছুটি কাটায়। মাদরাসার ছাত্রদের ছুটি বন্ধ করে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। মুফতি তাকি উসমানি সাহেব মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষকদের শরিয়তসম্মত সাধীনতা খর্ব করা অবৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। আমাদের আকাবির, বিশেষ করে দেওবন্দ মাদরাসায় অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত কালেকশনের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি নিয়োগ দেন। এ পদ্ধতিতে মাদরাসার ছাত্রদের পড়ালেখা ক্ষতি হয় না। ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন্ন হয় না।
দুই. বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সচ্ছল। টাকা দিয়ে পড়ানোকে অনেকেই মর্যাদাপূর্ণ মনে করে। যেসব মাদরাসায় ছাত্রদের প্রয়োজনীয় খরচ নেয়, সেখানেই অভিভাবকদের প্রথম চয়েস। অতএব ফ্রি পড়াশোনা পদ্ধতি পরিবর্তন করা সময়ের দাবি।
তিন. দীন শিক্ষাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম করা অনুচিত। মুফতি তাকি উসমানি বলেছেন, সঙ্গে ব্যবসা বা কোনো পেশা রাখা দরকার। বরকতের দোহাই দিয়ে কারও ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করা বৈধ হবে না।
চার. বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিন আছেন। বক্তা আছেন অগণিত। অধিকাংশই কওমি মাদরাসার ফসল। স্ব-স্ব অবস্থানে আমরা সাধারণ জনগণকে কওমি মাদরাসার প্রতি উৎসাহিত করতে পারি। মাদরাসায় দান-অনুদান, চামড়া ইত্যাদি যেন নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেন, ওলামায়ে কেরামের সম্মান যেন রক্ষা হয়, পড়ালেখা যেন তাদের ক্ষতি না হয়, এসব বিষয়ে আমরা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারি। অন্যথায় আমাদের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। মুফতি শফি (রহ.) তাঁর ছেলেদের অসিয়ত করেছিলেন, ‘আমি মাদরাসা খুলেছি, কোনো দোকান খুলিনি। অতএব ন্যায়নীতি ও শরিয়তের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে যে কোনো মূল্যে তা চালু রাখা, যে কোনো উপায়ে ছাত্র বৃদ্ধি করা অথবা অন্য মাদরাসার ক্ষতি করে আমার মাদরাসার উন্নতি করার দায়দায়িত্ব আমার নেই।’
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা