রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে শিক্ষার্থীদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন সাহসী শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী। তাঁর এই আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করতে সরকার দেশের সাহসী ও আত্মত্যাগী শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে ‘মাহেরীন চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড’ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মর্মান্তিক যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করে শিক্ষার্থীদের বাঁচানো সাহসী শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর নামে জাতীয়ভাবে পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের গৃহীত এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। ৭ আগস্ট বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সেখানে যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে আছেন দুজন শিক্ষক ও একজন আয়া। তাঁদের বিশেষ কী সম্মাননা দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। মাহেরীন চৌধুরী তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে বীরত্ব ও সাহস দেখিয়েছেন। তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটা জাতীয় পুরস্কার ঘোষণা করবে শিগগিরই। এই পুরস্কারের নাম হবে ‘মাহেরীন চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং সার্ভিসেস’। এটা শুধু শিক্ষকদের দেওয়া হবে।
সবারই জানা গত ২১ জুলাই দুপুরে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ ভবনের ওপরে ধসে পড়ে। এর বিস্ফোরণে তখন পুরো স্কুল-কলেজ ক্যাম্পাস সাক্ষাৎ নরককুণ্ডে পরিণত হয়। চারদিকে তখন শিক্ষার্থী শিশু-কিশোর-কিশোরী শুধু নয়, তাদের নিতে আসা স্বজন ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আগুনে-পোড়ার দৃশ্য। কেউ প্রাণ হারাচ্ছে, কেউ গুরুতর আহত হচ্ছে, সবারই দিশাহারা ছোটাছুটি, আর ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদ। স্কুলের বাইরে অভিভাবক-নারী-পুরুষের আর্তনাদও ছিল আল্লাহর আরশ স্পর্শ করার মতো। যে শিশু-কিশোররা সকালে স্কুলে এসেছিল অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের চিৎকার, বুকফাটা কান্নার রোলে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতরণা হয়।
এরই মধ্যে আগুনবিধ্বস্ত ভবন থেকে একটু দূরে পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় ছিলেন শিক্ষক মেহেরীন চৌধুরী। তিনি আগুনের ভিতর দিয়ে ছুটলেন আটকে পড়া সন্তানসম শিশুদের উদ্ধার অভিযানে। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন এমন দুঃসাহসী ভূমিকা কেবল সিনেমাতেই দেখা যায়- বাস্তবে নয়। উদ্ধারকারী সেনাবাহিনী ও অন্যান্য লোকজন বলেছেন মেহেরীন চৌধুরী নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে অন্তত ২০ জন শিশুকে নিজের কোলে নিয়ে এবং টেনেহিঁচড়ে বের করে আনেন। তারা তাঁর প্রাণপণ অভিযানে রক্ষা পায়। উদ্ধার অভিযানের সময় আগুন তাঁর গায়ে লাগে। সে অবস্থায়ও তিনি পিছপা হননি। নিজের জীবন বাঁচানোর চেয়ে সন্তানসম শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচানোকে কর্তব্য বলে ভেবেছেন। একপর্যায়ে তাঁর শরীরের প্রায় সবটাই অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি নিজেই ঢলে পড়েন। উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইনিস্টিটিউটে নিয়ে যান। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সেখানেই তিনি মারা যান ওই দিন রাত ১০টায়। সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আত্মত্যাগী নারী-শিক্ষক মেহেরীন চৌধুরীর অবদানের স্বীকৃতিদানের লক্ষ্যে শিক্ষকদের জন্য বার্ষিক পুরস্কার প্রদানের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
মাইলস্টোন স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ধসে পড়ে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩৫ জন। আহত প্রায় পৌনে দুই শ। কিন্তু শিশু-কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের মৃত্যু যেভাবে সবাইকে কাঁদিয়েছে, একইভাবে কাঁদিয়েছে শিক্ষক মেহেরীন চৌধুরীর প্রাণহানি। ৪৬ বছরের এই শিক্ষিকা এক বিশিষ্ট পরিবারের সন্তান ও অন্য এক বিশিষ্ট পরিবারের পুত্রবধূ। বিশ্বে এ ধরনের মানবিকতা ও আত্মদানের ঘটনা অতি বিরল। স্বার্থান্ধতার এই দুনিয়ায় মানুষের মাঝে যেখানে ক্ষমতা আর টাকার লোভে কোনো শাসক-নারী স্বৈরাচার হন, ফ্যাসিস্ট হয়ে যান, গণহত্যাকারী হন, রাষ্ট্র লুণ্ঠন করে মানুষকে অধিকতর ফকির বানানোর ব্যবস্থা করেন, তখন একজন মহৎ মানুষ, এক মহীয়সী নারী-শিক্ষক মেহেরীন চৌধুরী তাঁর শিশু-শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হন না। এই মেহেরীন চৌধুরীকে জাতির পক্ষ থেকে আমরা স্যালুট জানাই। আমরা তো এরকম শিক্ষকই চাই। প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকাকে মেহেরীন চৌধুরী তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সন্তানের মতো ভাবতে হবে। মাতৃসম মমতায় তাদের মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই জাতির মধ্যে মহামানব জন্মাতে সহায়ক হবে। আমরা কোনো ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা বা তাঁর চেলাচামুণ্ডা শিরীন শারমিন চাই না, আমরা ডা. দীপু মনি চাই না, আমরা বাটপার জান্নাত আরা হেনরি চাই না- আমরা মেহেরীন চৌধুরীর মতো অনুসরণীয় শিক্ষক চাই। তাহলেই আমাদের দেশ ও সমাজ প্রকৃত উন্নতির পথে এগোতে সক্ষম হবে। নারী-চামচা পুষে সেই মোসাহেবদের উচ্ছিষ্ট দিয়ে আমরা নারীর তথাকথিত ক্ষমতায়ন দেখতে চাই না। মেহেরীন চৌধুরীর মতো মহৎহৃদয় নারী কজন জন্মায় আমাদের সমাজে? খুবই কম জন্মায় এবং হয়তো শতবর্ষেও একজন কি না, বলা মুশকিল।এই ভদ্রমহিলা প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাজিন এম আর চৌধুরীর কন্যা বলে আমরা জানি। আমি ও জিয়াউর রহমান-ভ্রাতা কামাল ভাই তাঁর বাড়িতেও গিয়েছি একাধিকবার। তাঁর স্বামীও একটি বিখ্যাত পরিবারের সদস্য। তাঁদের প্রকৃত সম্মান জানানো দরকার জাতির পক্ষ থেকে। মেহেরীন চৌধুরীর মতো নারী মহামানব আসুক অবিরাম এই দেশে।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক