রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শনিবার সন্ধ্যায় জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে বিএনপিসহ দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা-বিশ্লেষণ করছে। সনদে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে। আর ১৫টি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে দলগুলো। এর মধ্যে ১০টি প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, জুলাই সনদের নোট অব ডিসেন্ট চূড়ান্ত খসড়ার মতামতে কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়ে আরও উদারতা দেখাবেন তাঁরা। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষের পিআর পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতিসহ দু-তিনটি বিষয়ে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে নানান আলোচনার পর এর বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বড় সংকট দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা ব্যবস্থা বের করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেই আলোচনায় আমরা অংশগ্রহণ করব।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এগুলো আমাদের মতামতে তুলে ধরা হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে জুলাই সনদ ঘোষণার কথাও বলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা রয়েছে। যদিও বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়নি। জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। আগামী সপ্তাহে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের। বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত হওয়ার পর সব দল সই করার মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত রূপ পাবে। জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলা হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন কোন পদ্ধতিতে হবে, তা দলগুলোকে জানানো হয়নি।
বিএনপি সূত্র বলেছেন, তাই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গতকাল রাতে আলোচনা হয়। কয়েকটি বিষয়ে ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আবারও এ নিয়ে আলোচনা শেষে নির্ধারিত সময় ২০ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে খসড়ার চূড়ান্ত মতামত দেওয়া হবে। ওই বৈঠকে ১০টি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়েও পুনর্বিবেচনার জন্য আলোচনা হবে। মোটা দাগে বিএনপি জুলাই সনদে আরও কিছুটা ছাড় দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে দু-তিনটি বিষয়ে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ২৫ আগস্ট থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেবে বিএনপি।
জুলাই সনদেই নির্বাচন চায় জামায়াত-এনসিপি, ভিন্ন অবস্থানে বিএনপি: জুলাই সনদ নিয়ে নানান আলোচনার পর এর বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় সংকট দেখা যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপির অবস্থান-আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হলে সেই সংসদই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। তবে ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদের মতো দলগুলো। তারা গণভোট-গণপরিষদ নির্বাচন কিংবা অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর দিকেই।
এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী বলছে, আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে শিগগিরই ঐকমত্য কমিশনের স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ গণভোট কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের তাগিদও দিচ্ছে তারা। ‘নোট অব ডিসেন্ট’, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে এখনো জটিলতা রয়েছে বলে মনে করছে কয়েকটি দল। তাদের মতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়ে জুলাই সনদ হতে পারে না। আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা তো এসব বিষয় পার্লামেন্টে বাস্তবায়ন করবে না। সে ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।
জামায়াতের দায়িত্বশীলরা বলছেন, ‘জুলাই সনদ আলোচনার ভিত্তিতে যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে, সে বিষয়গুলোতে কোনো ধরনের গ্যাপ আছে কি না দেখতে হবে। অনেক সময় ছাপায়ও ভুল হয়। ঐকমত্য কমিশনসহ সবাই মিলে কষ্ট-পরিশ্রম করেছি। রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে, অনেক সময় গেছে। এর মধ্য দিয়ে একটা খসড়া তৈরি হয়েছে। এটা চূড়ান্ত হবে। চূড়ান্ত করার পর আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা হবে। তার পরে বাস্তবায়ন করা হবে। এ ধাপগুলো এখনো অবশিষ্ট।’ নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি বা বাস্তবায়ন নিয়েও নিজেদের মধ্যে আরও কথাবার্তা বলতে হবে। নোট অব ডিসেন্ট বিষয়গুলো নিয়ে আগামী পার্লামেন্টে আলোচনা হবে। আমার ধারণা, বিএনপি দেখতে চাইছে আগামী নির্বাচনে তারা কেমন ভোট পায়, তার ভিত্তিতে তারা সুযোগ দেবে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট থাকলে তো আর বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এখনো সময় আছে, আরও আলোচনা হবে দেখা যাক।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের মৌলিক দাবি ছিল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। কিন্তু জুলাই সনদে পিআর পদ্ধতি নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এটা আরও অনেক দলের দাবি ছিল। আমরা মনে করি অন্য সংস্কারগুলো যা আছে, সব ঠিক আছে। কিছু বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সেগুলো মেনে নিয়েছি।’
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ড্রাফট আমরা শনিবার হাতে পেয়েছি। আগে যে ড্রাফটটা পেয়েছিলাম তার আলোকে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম, কিছুটা তার আলোকে পরিমার্জিত হয়েছে, সেজন্য আমরা সন্তুষ্ট। এর পরও আমরা আমাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ ও মতামত সহসা ঐকমত্য কমিশনকে অফিশিয়ালি জানাব।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘প্রথমত এখানে কোনো ঐকমত্য হয়নি। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে কোনো ঐকমত্য হয় না। সুতরাং ওই দলগুলো তো ক্ষমতায় গেলে তা বাস্তবায়ন করবে না। দ্বিতীয়ত প্রথম পাঠানো খসড়া থেকে দ্বিতীয় দফা খসড়ায় বাস্তবায়ন নিয়ে ভিন্ন কথা রয়েছে। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’