সূর্যেও পৃথিবীর মতো ঝুম বৃষ্টি নামে। শুনে একটু খটকা লাগছে তো? এমন আগুনের লেলিহানের মধ্যে অমীয় জলধারার বৃষ্টি! কেমনে সম্ভব? নাহ, এই বৃষ্টি মানে পৃথিবীর মতো আকাশ থেকে নেমে আসা অবারিত বারিধারা নয়। তা আদতে সম্ভবও না। তবে সূর্যে যে বৃষ্টি হয় তা আসলে প্লাজমার বৃষ্টি।
বহু বার এই মহাজাগতিক ঘটনার প্রত্যক্ষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই ঘটনার নেপথ্য-কারণ খুঁজতে গিয়ে নানা যুক্তিও সাজিয়েছিলেন তারা। সেই সব পুরনো ধারণা ভেঙে দিয়ে এ বার নতুন তথ্য হাজির করেন আমেরিকার ‘ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি’র দুই বিজ্ঞানী; জেফ্রি রিপ এবং তার ছাত্র লুক বেনাভিৎজ।
পদার্থের তিন অবস্থা কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় অবস্থা। এর বাইরেও চতুর্থ অবস্থা রয়েছে পদার্থের। একেই প্লাজমা বলে। মূলত হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস প্রবল উত্তাপে আয়নিত হয়ে প্লাজমা তৈরি হয়, যা দিয়ে সূর্যের বাইরের এবং ভিতরের অংশ গঠিত। সূর্যের বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তরকে বলে ‘করোনা’। এই স্তরেই কখনও কখনও ঠান্ডা এবং ঘন প্লাজমার দলা পাকায়। পরে সেই প্লাজমার দলা দ্রুত তাপ বিকিরণ করে ভারী হয়ে সূর্যের পিঠে নেমে আসে, যা দেখতে অনেকটা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার মতো। একেই সৌরবৃষ্টি বা ‘করোনাল রেইন’ বলে থাকেন বিজ্ঞানীরা।
এতকাল বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, সূর্যের বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন পদার্থের (লোহা, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন) যে মিশ্রণ রয়েছে, তা আসলে ধ্রুবক বা কনস্ট্যান্ট। প্রতিটি পদার্থের তাপ বিকিরণের নির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। সেই কারণে করোনায় দলা পাকানো প্লাজমা ঠান্ডা হতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন লেগে যায়।
এই যুক্তিকে অস্বীকার করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রিপ এবং বেনাভিৎজ। তাদের দাবি, প্লাজমা ঠান্ডা হতে পূর্ব ধারণা অনুযায়ী এতো সময় লাগে না। কয়েক মিনিটেই তা ঠান্ডা হয়ে বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ে। সূর্যের অন্দর থেকে শক্তি ছিটকে বেরিয়ে মহাশূন্যে যে আগুন ঝরানো সৌরঝলক (সোলার ফ্লেয়ার) তৈরি হয়, তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখা যায় এই সৌরবৃষ্টি।
প্লাজমা কেন এবং কী ভাবে এত দ্রুত ঠান্ডা হয়, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাদের গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্যাল জার্নাল’-এ। রিপ এবং বেনাভিৎজের মত, সূর্যের বায়ুমণ্ডলে থাকা বিভিন্ন পদার্থের মিশ্রণ ধ্রুবক হওয়া সম্ভব নয়। তা পরিবর্তনশীল। সৌরঝলকের মতো সেই মহাজাগতিক ঘটনার সময় এই সব পদার্থের চরিত্র বদলে যায়। লোহা খুব দ্রুত যেমন তাপ শুষে নিতে পারে, তেমনই দ্রুত তাপ বিকিরণও করতে পারে। আবার কখনও কখনও এই সব পদার্থের অনুপাত বদলে যেতে পারে। প্লাজমা দ্রুত ঠান্ডা হবে কি না, এই অবস্থার উপরেও অনেক সময় নির্ভর করে।
রিপ বলেন, এই গবেষণা শুধু সৌরবৃষ্টি নিয়ে নয়। বরং তার থেকে অনেক বেশি কিছু। সূর্যের বায়ুমণ্ডলে কী কর্মকাণ্ড চলে, তার খানিক আভাস মিলেছে এই গবেষণা থেকে। শুধু তা-ই নয়, এই গবেষণার সূত্র ধরে ভবিষ্যতে সৌরঝলক, সৌরঝড় বা করোনাল মাস ইজেকশনের মতো মহাজাগতিক ঘটনার গভীর জ্ঞান মিলতে পারে, যা অত্যন্ত জরুরি।’
সূর্য থেকে পৃথিবীর বুকে ধেয়ে আসা সৌরঝড়, সৌরবায়ু এবং অসম্ভব শক্তিশালী সৌরকণার (সোলার পার্টিকেল) উৎপত্তি আসলে সূর্যের বায়ুমণ্ডলই। ১০০ কোটি বা তারও অনেক বেশি পরমাণু বোমা এক সঙ্গে ফাটলে যে পরিমাণ শক্তির জন্ম হয়, এরা ততটাই শক্তিশালী। এদের বলে ‘করোনাল মাস ইজেকশন’। এরা প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটাতে পারে। এই সৌরঝঞ্ঝাগুলো যদি বিনা বাধায় সরাসরি পৃথিবীর পিঠে আছড়ে পড়ত, তা হলে এখানে প্রাণের অস্তিত্বই থাকত না। তা হয়নি, কারণ এই বিপদকে আটকে দেয় পৃথিবীর চৌম্বকমণ্ডল (ম্যাগনেটোস্ফিয়ার)। এটাই আমাদের গ্রহের বর্ম হিসেবে কাজ করে। হানাদার সৌরঝড়, সৌরবায়ু আর সৌরকণারা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়তে চাইলে চৌম্বকমণ্ডলের সঙ্গে তাদের তুমুল লড়াই হয়। আর সেটা পৃথিবীর দুই মেরুতেই সবচেয়ে বেশি হয় বলে আমরা আলো ঝলসে উঠতে দেখি। যাকে বলা হয় অরোরা বা মেরুজ্যোতি।
কিন্তু চৌম্বকমণ্ডলও সবটা যে আটকে দিতে পারে, তা-ও নয়। তীব্র ধাক্কাধাক্কির পর ফাঁক গলে কিছু ঝড়ঝাপ্টা ঢুকে পড়ে আয়নোস্ফিয়ারে। সেটুকুর বিপদও কিন্তু খুব কম নয়। তেমন ভাবে বাগে পেলে তারা পৃথিবীর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। মেরুর উপর দিয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় উড়ে যাওয়া বিমান যদি ‘উন্মত্ত’ সৌরঝড়ের মুখোমুখি হয়, তা বিমানের সেন্সরকে অকেজো করে দিতে পারে। কেটে দিতে পারে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে বিমানের যাবতীয় যোগাযোগ। তার ফলে দিশাহীন হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে বিমান। অচল করে দিতে পারে বা পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে পৃথিবীর কক্ষপথগুলিতে পাক খাওয়া হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহকেও। আমূল বদলে দিতে পারে আমাদের মহাকাশের আবহাওয়া (স্পেস ওয়েদার)।
এই সব কারণেই এই ধরনের সৌরঝঞ্ঝার গতিবিধি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এর জন্য জরুরি সূর্যের বায়ুমণ্ডল অর্থাৎ করোনার চরিত্র বোঝা। সাম্প্রতিক গবেষণার সূত্র ধরে তা খানিক সম্ভব হতে পারে বলেই অনুমান রিপ এবং বেনাভিৎজের।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল