বিশ্বজুড়ে অপরাধ শনাক্তকরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্টপদ্ধতি (আঙুলের ছাপ) আজ একটি অপরিহার্য প্রযুক্তি। আঙুলের ছাপ দিয়েই খুলছে মোবাইল ফোনের লক, গেটের তালা, নিশ্চিত করা হচ্ছে অফিসের উপস্থিতি, যাচাই করা যাচ্ছে কে অপরাধী ইত্যাদি। অথচ এই যুগান্তকারী ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিটেকশন সিস্টেম আবিষ্কারের অন্যতম উদ্ভাবক একজন বাঙালি বিজ্ঞানী, যাঁর নাম আজও অনেকের কাছে অজানা, তিনি খান বাহাদুর কাজী আজিজুল হক। কাজ করতেন তৎকালীন (১৮৯২ সাল থেকে) বেঙ্গল পুলিশে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে অনেকেই আগে কাজ করেছেন কিন্তু এর প্র্যাকটিক্যাল ইউজ কী, কীভাবে যাচাই করা যায়, কীভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে নমুনা আলাদা করা যায়, সেটা প্রথম আবিষ্কার করেন আমাদের দেশের কাজী আজিজুল হক। ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল পুলিশের আইজি ছিলেন অ্যাডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। তিনি ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে গবেষণার জন্য নিয়োগ করেন দুই বাঙালি প্রতিভাকে, একজন গণিতবিদ কাজী আজিজুল হক, আরেকজন হেমচন্দ্র বোস।
কাজী আজিজুল হক ও হেমচন্দ্র বোস ৭ হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের এক বিশাল ডেটা সেট গড়ে তোলেন। অনেক পরিশ্রম করে একটা গাণিতিক সূত্র দাঁড় করান, যেটা দিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে মানুষ শনাক্ত করা যায়, যা আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিশাল আবিষ্কার। এ পদ্ধতির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বোস-হক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম’। কিন্তু ওখান থেকেই ইংরেজদের বেইমানি শুরু। পুলিশের আইজি হেনরি সাহেব এবার সবার কাছে প্রচার করা শুরু করলেন যে এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিটেকশন সিস্টেম আবিষ্কার করেছেন উনি নিজেই। এমনকি কাজী আজিজুল হককে কোনোরকম স্বীকৃতি দিতেই অস্বীকার করলেন। নিজের বৈধতা প্রকাশ করার জন্য তিনি চুপিচুপি একটা সায়েন্টিফিক পেপারও পাবলিশ করলেন নিজের নামে। ব্যস, বাংলাদেশের কাজী আজিজুল হক আবিষ্কৃত সিস্টেমের নাম হয়ে গেল ‘হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেম’। এ সিস্টেম এখন মোবাইল ফোনের টাচে, অফিস ও বাসার দরজা খোলায়, অপরাধী শনাক্তকরণে এমনকি বলতে গেলে যত জায়গায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে, তত জায়গায় এই হেনরি ক্লাসিফিকেশন সিস্টেমই ব্যবহার করা হচ্ছে। কাজ করে গেলেন আমাদের দেশের সূর্যসন্তান, নাম হয়ে গেল ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার নামে।
২০০১ সালে প্রকাশিত কলিন বিভান তাঁর ফিঙ্গারপ্রিন্টস গ্রন্থে (২০০১ সালে প্রকাশিত) গবেষণার মৌলিকত্ব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানান- অ্যানথ্রোপমেট্রিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আজিজুল হক ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হন। ফলে নিজেই হাতের ছাপ তথা ফিঙ্গারপ্রিন্টের শ্রেণিবিন্যাসকরণের একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন। তিনি উদ্ভাবন করেন একটা গাণিতিক ফর্মুলা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ৩২টি থাক বানান। সেই থাকের ৩২টি সারিতে সৃষ্টি করেন ১ হাজার ২৪টি খোপ। কলিন বিভান আরও জানাচ্ছেন, ১৮৯৭ সাল নাগাদ হক তাঁর কর্মস্থলে ৭ হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশাল এক সংগ্রহ গড়ে তোলেন। তাঁর সহজসরল এই পদ্ধতি ফিঙ্গারপ্রিন্টের সংখ্যায় তা লাখ লাখ হলেও শ্রেণিবিন্যাস করার কাজ সহজ করে দেয়। বর্তমান সময়েও ফিঙ্গারপ্রিন্টের বহুবিধ ব্যবহার বিশ্বখ্যাত যেমন : মানুষের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করার একটি নির্ভরযোগ্য উপায়, যা বিভিন্ন ডেটা সুরক্ষা সিস্টেমের জন্য নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। অনেক কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের সময় এবং উপস্থিতি ট্র্যাক করার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি আজকাল বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেমেন্ট, ফিঙ্গারপ্রিন্টভিত্তিক অ্যান্ট্রি সিস্টেম ইত্যাদি। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন মোবাইল ফোন আনলক করা, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নিরাপত্তা, অপরাধ তদন্ত এবং বায়োমেট্রিক ডেটা সুরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
ফিঙ্গারপ্রিন্টের জনক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কাজী আজিজুল হকের পারিবারিক নাম কাজী সৈয়দ আজিজুল হক। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭২ সালে। ব্রিটিশ ভারতের খুলনা জেলার ফুলতলার পয়োগ্রাম কসবায়। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের ছাত্র ছিলেন। ১৮৯২ সালে তিনি কাজ শুরু করেন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। তখন অ্যানথ্রোপমেট্রি (মানবদেহের আকৃতি) পদ্ধতিতে অপরাধীদের শনাক্ত করার কাজ চলত। গণিতের ছাত্র এবং সদ্য সাব-ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পাওয়া আজিজুল হক অক্লান্ত চেষ্টার ফলে তিনি যে পদ্ধতি উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করলেন, তা-ই ‘হেনরি সিস্টেম’ বা ‘হেনরি পদ্ধতি’ নামে পরিচিত হলো। কাজের পুরস্কার হিসেবে আজিজুল হককে দেওয়া হয়েছিল ‘খান বাহাদুর উপাধি’, ৫ হাজার টাকা এবং ছোটখাটো একটা জায়গির। চাকরিতে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন পুলিশের এসপি। অবিভক্ত ভারতের চম্পারানে (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যের একটি জেলা, যা উত্তর চম্পারান নামে পরিচিত) কাটে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। সেখানেই তিনি ১৯৩৫ সালে মারা যান। বিহারের মতিহারি স্টেশনের অনতিদূরে তাঁর নিজের বাড়ি ‘আজিজ মঞ্জিল’-এর সীমানার মধ্যে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে চলে আসেন। মরহুম আজিজুল হকের পুত্র আসিরুল হক পুলিশ বিভাগের ডিএসপি হয়েছিলেন। তাঁর দুই বিখ্যাত নাতি ও নাতনি হচ্ছেন যথাক্রমে ইতিহাসের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ (১৯২২-২০১৪) এবং শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী (১৯৩৮-২০২১)।
যদিও বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী কাজী আজিজুল হকের নাম তেমন প্রচার পায়নি, কিন্তু ব্রিটেন তাঁকে ভুলে যায়নি। ব্রিটেনের ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি’ ফেন্সির উদ্যোগে তাঁর ও হেমচন্দ্র বোসের সম্মানে চালু করেছে ‘দ্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট সোসাইটি আজিজুল হক অ্যান্ড হেমচন্দ্র বোস প্রাইজ’। ফরেনসিক বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা গবেষকদের এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলার এই বিস্মৃত নায়ককে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। তাঁর অবদান শুধু অতীত ইতিহাসের অংশ নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও ফরেনসিক বিজ্ঞানের এক মাইলফলক। তাই আজিজুল হকের জীবন ও কর্ম নিয়ে আরও গবেষণা ও আলোচনা হওয়া উচিত, যেন তাঁর নাম কেবল পুরস্কারের তালিকায় নয়, আমাদের প্রেরণার অংশ হয়ে থাকে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়