ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের শেষ দিন ছিল গতকাল। রাতে জরুরি বৈঠকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমার সময় এক দিন বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখন চূড়ান্ত লড়াইয়ের অপেক্ষা। গতকাল সরব ছিলেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আটটি প্যানেল আলাদা আলাদাভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে। তবে অধিকাংশ সংগঠনই প্যানেলের নাম ও পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় এক ছাত্রদল নেত্রী মবের স্বীকার হয়েছেন।
এ বছর ডাকসু নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল, ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-সমর্থিত ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল, ছাত্র অধিকার পরিষদ-সমর্থিত ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন-সমর্থিত প্যানেল, বাম ছাত্রসংগঠনসমূহের গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট-সমর্থিত প্যানেলে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে একটি এবং ‘ডিইউ ফার্স্ট’ নামে আরেকটি স্বতন্ত্র প্যানেলে প্রার্থীরা মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। এদিকে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ও ‘জুবায়ের-মুসাদ্দেক স্বতন্ত্র প্যানেল’ আংশিক দুটি প্যানেল নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন প্যানেল থেকে ৫৬৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল সংসদে মোট মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ১ হাজার ২২৬ জন। তবে ভিপি, জিএস বা অন্যান্য পদে কতজন মনোনয়ন নিয়েছেন, তা জানায়নি নির্বাচন কমিশন।
ডাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, সপ্তম দিনে ডাকসুর বিভিন্ন পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৪৪২ জন। এখন পর্যন্ত ৭ দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৫৬৫ জন এবং হল সংসদে মোট মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে ১ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে ভিপি, জিএস, এজিএস, সম্পাদক এবং সদস্য পদে কতজন তা এখনো নির্ণয় করা হয়নি।
প্রার্থী ও ভোটার তালিকায় অপরাধী থাকলে বাদ পড়বেন এমন প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এখানে কেউ কোনো দলীয় পরিচয়ে মনোনয়ন নেননি। ভোট গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত কোনো প্রার্থীর নাম অপরাধীর তালিকায় পাওয়া গেলে তাকে প্রার্থিতা থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে।’ মনোনয়ন গ্রহণের শেষ দিনে প্যানেল ঘোষণা করে ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র অধিকার পরিষদ। তবে চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে ছাত্রদল, বামপন্থি ছাত্রজোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও অন্যান্য সংগঠন।
ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল : শেষ দিনেও নিজেদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনটির একাধিক নেতাকে আলাদা আলাদাভাবে মনোনয়ন ফরম নিতে দেখা গেছে।
ভিপি পদে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম জিসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জিএস পদে সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সদস্যসচিব আবিদুর রহমান মিশু, ঢাবি ছাত্রদলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জারিফ রহমান, জসীম উদ্দীন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক তানভীর বারী হামিম এবং এজিএস পদে বিজয় একাত্তর হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক তানভীর আল হাদী মায়েদসহ কয়েকজন মনোনয়ন নিয়েছেন।
মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খান জানান, ‘আমরা এখন শুধু মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছি। তবে কারা কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেবেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেল গঠিত হবে।’
ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট : ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নামে ২৮ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে। ঘোষিত প্যানেলে ভিপি পদে আছেন সাদিক কায়েম, জিএস পদে এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মহিউদ্দিন খান। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও গণ আন্দোলন পদে যুক্ত হয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের ফাতিমা তাসনীম জুমা, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে রয়েছেন জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো খান জসীম। সদস্য পদে লড়বেন সর্ব মিত্র চাকমা ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রাইসুল ইসলাম। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ শেষে শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ‘আমরা একটি ইনক্লুসিভ প্যানেল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, নারী, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি যাঁরা জুলাই আন্দোলন ও ফ্যাসিবাদী সময়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কথা বলতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাঁদের আমাদের প্যানেলে রাখার চেষ্টা করেছি।’
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন : ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ ৭ আগস্ট সম্ভাব্য প্যানেল ঘোষণা করে। ভিপি পদে ইয়াসিন আরাফাত, জিএস পদে খায়রুল আহসান মারজান এবং এজিএস পদে সাইফ মুহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানানো হয়। তবে অন্য সংগঠন বা স্বতন্ত্রদের সঙ্গে সংযুক্ত প্যানেলেও যেতে পারেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ : বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ নামে প্যানেল ঘোষণা করে। এতে ভিপি পদে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের এবং জিএস পদে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় মুখপাত্র আশরেফা খাতুন এজিএস, কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে লড়বেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ডাকসু ফর চেঞ্জ : কয়েকটি পদ বাকি রেখে ছাত্র অধিকার পরিষদ ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ নামে চূড়ান্ত প্যানেল ঘোষণা করেছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা ভিপি এবং সাবিনা ইয়াসমিন জিএস পদে লড়বেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া এজিএস পদে লড়বেন সংগঠনটির ঢাবি শাখার সদস্যসচিব রাকিবুল ইসলাম।
বাম ছাত্রজোট : বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর সমন্বিত জোট গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট ভিপি পদে মনোনয়ন নিয়েছেন ২০১৯ সালে শামসুন্নাহার হল সংসদের নির্বাচিত সহসভাপতি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি এবং জিএস পদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু। এজিএস পদে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণ আন্দোলন সম্পাদক পদে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক ফরম সংগ্রহ করেছেন।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন : আংশিক প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেবে ছাত্র ফেডারেশন। সংগঠনটির ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আরমানুল হক এজিএস, সদস্যসচিব সাকিবুর রনি স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক, সীমা আক্তার সমাজসেবা সম্পাদক পদে লড়বেন। নির্বাচনে চূড়ান্ত হয়নি তাঁদের প্যানেল। জানা গেছে, অন্য কোনো সংগঠন বা স্বতন্ত্র প্যানেলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাঁদের।
ডিইউ ফার্স্ট : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামালুদ্দীন মোহাম্মদ খালিদের নেতৃত্বে ‘ডিইউ ফার্স্ট’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করা হয়। ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জামালুদ্দীন মোহাম্মদ খালিদ এবং জিএস পদে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব মাহীন সরকার।
উমামা ফাতেমার প্যানেল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা স্বতন্ত্র প্যানেলের ঘোষণা দিয়েছেন। ভিপি পদে তিনি নিজে লড়বেন। জিএস পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূইয়া এবং এজিএস পদে বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এ প্যানেলের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’।
জুবায়ের-মুসাদ্দেকের আংশিক প্যানেল : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখ্য সমন্বয়ক এবি জুবায়ের ও জুলাই ঐক্যের সংগঠক মুসাদ্দেক আলী ইবনে মুহাম্মদ আংশিক স্বতন্ত্র প্যানেলের ঘোষণা দিয়েছেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মুসাদ্দেক এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে জুবায়ের মনোনয়ন নিয়েছেন। তবে তাঁদের অন্য প্যানেলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় মবের শিকার ছাত্রদল নেত্রী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের সময় মব সৃষ্টি করে হল শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মালিহা বিনতে খানকে (অবন্তী) বাধা প্রদান ও হেনস্তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে এ বিষয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটি। এ সময় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, ওই হলে বিকাল ৪টার আগে মালিহা বিনতে খানের নেতৃত্বে ছাত্রদলের কিছু শিক্ষার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে যান। এ সময় একদল উগ্র শিক্ষার্থী তাঁদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহে বাধা দেয় এবং মব উসকে দিয়ে অবন্তীসহ তাঁদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের চেষ্টা চালায়।
এ ঘটনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন ছাত্রদল নেতারা। এ ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে মিটিংয়ে বসেছি। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেখা যাক কী করা যায়।’ মব সৃষ্টি করার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আহ্বায়ক হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. রবিউল ইসলাম।