কেবল যে বাংলাদেশের ব্যাপার, তা কিন্তু নয়, বিশ্বজুড়েই পুঁজিবাদ নিষ্ঠুর দৌরাত্ম্য চালিয়ে যাচ্ছে। তার চরিত্র এখন নির্ভেজাল ও নির্লজ্জরূপে ফ্যাসিবাদী। সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে রক্ষণশীলদের চরম বাড়াবাড়ি। এমনটা এভাবে আগে কখনো দেখা যায়নি। নেতারা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের আওয়াজ তুলে নিজেদের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এমনকি ‘গণতান্ত্রিক’ আমেরিকার সর্বক্ষমতা এখন এক ব্যক্তির হাতে। তিনি ইচ্ছামতো হুকুম দিচ্ছেন এবং তা তামিল করা হচ্ছে। খোদ রাজধানী ওয়াশিংটনে আশ্রয়হীন বেশ কিছু মানুষ তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেছেন। ট্রাম্পরা নিজেরাই অবশ্য বিদেশি; এসেছেন ইউরোপ থেকে। কিন্তু নীতি নিয়েছেন আমেরিকা থেকে বিদেশিদের বিতাড়নের। ইতালিতে মুসোলিনির পার্টির লোকেরা ক্ষমতায় বসে গেছে। জার্মানিতে নাৎসিদের পুনরুত্থান ঘটেছে। ইংল্যান্ডে লেবার পার্টি বুর্জোয়া চরিত্র ধারণ করেছে। ইহুদি জাতীয়তাবাদী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনবাসীকে সেভাবেই হত্যা করছে, একদা জার্মান জাতীয়তাবাদীরা যেভাবে ইহুদিদের হত্যা করেছিল। হিটলারের হত্যাকা- ছিল সাময়িক, নেতানিয়াহুদের হত্যাকা- চলছে যুগের পর যুগ।
আগে এসব ঘটনার প্রতিবাদ হতো। এখনো যে হয় না তা নয়; তবে আওয়াজ বড়ই ক্ষীণ। তিন কারণে। প্রথমত অনেক মিডিয়া সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিলিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। দ্বিতীয়ত দুনিয়াজুড়েই মানুষ এখন নিজের ধান্দায় অতিশয় ব্যস্ত। ধনী আরও ধনী হতে চায়। আর ধনহীনরা নিজের সংসার চালাতে এমন হিমশিম খায় যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে রুখে দাঁড়াবে এমন ফুরসতই পায় না। তৃতীয়ত বিরুদ্ধবাদীদের ওপর নানা প্রকার নিপীড়ন চলে। চেষ্টা চলে কেবল কণ্ঠরোধের নয়, মেরুদ- ভেঙে ফেলারও। এসব কারণে দেখা যায় রক্ষণশীলরাই ভোট পায় এবং নির্বাচিত হয়ে আসে।
বিশ্বের পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদীরা এখন রীতিমতো গণহত্যা চালাচ্ছে। গণহত্যা বিভিন্ন রকমের। প্রত্যক্ষ গণহত্যা ঘটছে যুদ্ধ বাধিয়ে, উভয় পক্ষকে যুদ্ধে উসকানি দিয়ে এবং মারণাস্ত্র বিক্রি করে। অপ্রত্যক্ষ গণহত্যা ঘটছে মারণাস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি মাদকের ব্যবসার মধ্য দিয়ে। সবচেয়ে বড় এবং ধারাবাহিক গণহত্যা চলমান রয়েছে জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটিয়ে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নয়নের কাঁচামাল এবং বর্জ্য ফেলার আধার হিসেবে। প্রকৃতিও বদলা নিচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, বন্যা, দাবদাহ, প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার ইত্যাদি ঘটিয়ে। পানি, বাতাস, মাটি, আকাশ, পাতাল সবই এখন প্রাণঘাতী রূপে দূষিত।
পুঁজিবাদীদের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়। ট্রাম্প ও মোদির কোলাকুলি ধাক্কাধাক্কির রূপ নেয়। কিন্তু এসব হচ্ছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব বিরোধ; মেহনতি মানুষকে পীড়ন করার ব্যাপারে শাসকরা অবিচ্ছেদ্যরূপে ঐক্যবদ্ধ। নেতানিয়াহু ও মোদি পরস্পরকে আকর্ষণ করে; কে যে লোহা আর কে যে চুম্বক, বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদীদের হাতে পড়ে জাতীয়তাবাদ আগ্রাসি ও নির্যাতনকারী রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। তাই বলে জাতি জিনিসটা যে মিথ্যা, তা তো নয়। জাতি আছে এবং থাকা দরকারও। বাগানে যেমন অনেক ফুল ফোটে এবং ফুল না থাকলে জায়গাটা জঙ্গলে পরিণত হয়, পৃথিবীতে তেমনি মনুষ্যত্বের সংরক্ষণ ও বিকাশের প্রয়োজন। জাতিগত পৃথক অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। জঙ্গল কেটে যন্ত্র বসালে সাম্য আসে না, বৈষম্যই বৃদ্ধি পায়। যন্ত্রের মালিকরা তাদের শোষণের কলাকৌশলের উন্নতি ঘটায়।
আর জাতির প্রধান পরিচয় পাওয়া যায় ভাষায়। একজন মানুষ একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারে এবং বলতে পারাটা উপকারীও বটে। কিন্তু ওই মানুষটির আসল পরিচয় পাওয়া যায় মাতৃভাষার ব্যবহারে। ভারতে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকেছেন। হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা এখন ‘বাংলার গান’ গাইছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনও ঘটছে। পাশাপাশি আসামেও বাংলা ভাষাকে হেনস্তা করার অভিযোগে প্রতিবাদী আন্দোলন হয়েছে। হিন্দিবলয়ের বাইরে বিভিন্ন ভাষাভাষীরা তাদের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আগেও প্রতিবাদ করেছেন, এখন তা প্রবলতর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পনেরো বছরের শাসনে নানা ধরনের দুর্নীতি ও জননিপীড়নের দরুন যে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছেন, সেটা পুনরুদ্ধারের জন্য শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে আঁকড়ে ধরেছেন। ইতিহাসের এ এক চমৎকার বক্রাঘাত বৈকি। কারণ একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসূরি ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই ভীষণ তৎপর ছিলেন অখ- বাংলাদেশকে ভেঙে দুই টুকরা করে কলকাতাকে নিজেদের দখলে রাখার জন্য। আওয়াজ তুলেছিলেন ভারতবর্ষ যদি ভাগ না-ও হয়, তাহলেও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। এত দিনে তাদের বোধোদয় হয়েছে যে ভারতবর্ষ এক জাতির বা দুই জাতির দেশ নয়; বহু জাতির একটি উপমহাদেশ বটে। যেন ছোটখাটো একটি ইউরোপ।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী শাসন বিদ্যমান। পাকিস্তানের কালে ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ। তারপরে বহাল হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত শাসক ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেছেন, তাঁরা সবাই নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলেই পরিচয় দিয়েছেন। আগামী দিনে যাঁরা আসবেন তাঁরাও যে একই পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবেন, এটাও নিশ্চিত। এবং সে সঙ্গে এটাও হলফ করেই বলা চলে যে সে জাতীয়তাবাদ অবশ্যই হবে পুঁজিবাদী ঘরানারই। বিরোধী দলের আসনে যাঁরা বসবেন, তাঁরাও। চব্বিশের জুলাই-আগস্টে যে অভ্যুত্থানটি ঘটল, অনেকেই মনে করেন তাতে বিপ্লবই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা কী জনগণের কাছে গেছে, বা যাবে? সে সম্ভাবনা তো স্বপ্নবৎ।
পুরোনো কথাই বারবার বলতে হয়। সামাজিক বিপ্লবের বাইরে রাজনীতিতে ও সমাজে যেসব ঘটনা ঘটবে, তা যত বড় মাত্রারই হোক না কেন, সেসবকে বিপ্লব বলাটা খুবই বিভ্রান্তিকর। কেননা ওই সব বিপ্লবের আসল উদ্দেশ্য সামাজিক বিপ্লবকে প্রতিহতকরণ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এজন্য বাংলাদেশে আজ যা প্রয়োজন সেটা হলো সমাজবিপ্লবীদের একটি যুক্তফ্রন্ট।
বর্তমান বিশ্বে নিকৃষ্টতম রাষ্ট্রশক্তি হচ্ছে ইসরায়েল। তাদের গণহত্যা, বর্বরতম অমানবিক পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে বৈকি। খোদ ইসরায়েলেই প্রতিবাদ উঠেছে। এক লাখের মতো রিজার্ভ সৈন্য ছুটির পরে কাজে ফেরেননি। নৃশংসতার মাত্রা সহ্য করতে না পারার কারণে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে। ২০২৪ এই সংখ্যা ছিল ১৪, আগের বছর ১১। কিন্তু তাতে জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাঁর হাত নিশপিশ করছে মানুষ মারার জন্য। বিশেষ করে শিশু ও নারী হত্যাতেই তার উৎসাহ সর্বাধিক। সাংবাদিকরাও বাদ যাচ্ছেন না। এক দিনে ফিলিস্তিনে কর্তব্যরত আলজাজিরার ৫ জনসহ ৭ জন সাংবাদিক নিহত হন।
এর আগে আলজাজিরার একজন মহিলা সাংবাদিককে যখন হত্যা করা হয়, তখন বিশ্বজুড়ে একটা ধিক্কার ধ্বনি শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তাতে জায়নবাদীদের নৃশংসতা বিন্দুমাত্র কমেনি; বরং দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধিই পেয়েছে। ফিলিস্তিনে কর্তব্যরত অবস্থায় ২২ মাসে ২০০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। কারণ ওই একই। পুঁজিবাদের নৃশংসতা বৃদ্ধি।
বর্তমান বিশ্বের সেরা ধনী ইলন মাস্ক বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প হচ্ছেন আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনের ‘সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধী।’ অথচ কিছুদিন আগেও এঁরা ছিলেন একে অন্যের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। পরস্পরকে তাঁরা হাড়ে হাড়ে চেনেন। তবু বন্ধু হন, আবার শত্রু বনে যেতেও বিলম্ব ঘটে না। পুঁজিবাদীদের স্বভাব ওই রকমেরই; ক্ষণে মিত্র ক্ষণে শত্রু।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ