দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ধীরগতির প্রভাব ও বিনিয়োগ খরায় স্বল্পমেয়াদি ধাক্কার মুখে পড়েছে ইস্পাতশিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়তি উৎপাদন ব্যয়, চাহিদা কমে যাওয়া এবং উচ্চ করের বোঝার মতো একগুচ্ছ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প।
তবে নেতিবাচক দিকগুলো সত্ত্বেও খাতটির সম্ভাবনা অটুট। কারণ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ফলে চলমান মন্দা কেটে গিয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে ইস্পাতশিল্পে, এমনটাই আশা করছেন উদ্যোক্তারা।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বাজারে চাহিদা কমার পাশাপাশি অর্থায়ন ব্যয় বৃদ্ধি, কর বৃদ্ধি, জ্বালানি ঘাটতি ও বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ইস্পাত খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের কারখানাগুলো, যাদের কাঁচামালের ৮০ শতাংশের বেশি আমদানিনির্ভর, তারা এখন সরবরাহ নিশ্চিত করতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে। গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার গ্যাস ও বিদ্যুতের ট্যারিফ বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মুদ্রার অবমূল্যায়ন।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যমতে দেশে বছরে ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টন ইস্পাত উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে না। প্রায় ২০০ ইস্পাত কারখানার মধ্যে ৪০টির বেশি বৃহৎ হলেও অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন মুনাফা কমে যাওয়া অথবা লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে বাজারে প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৮৩ হাজার ৫০০ থেকে ৮৬ হাজার টাকায়। এক বছর আগে দাম ছিল ৯০ হাজার ৫০০ থেকে ৯২ হাজার ৫০০। অর্থাৎ দাম কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। ফলে বাজারের মোট চাহিদা নেমে এসেছে ৫০ লাখ টনে, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ কম।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইস্পাতশিল্পের উত্থান শুরু হয় ২০০০ সালের শুরুর দিকে। দ্রুত নগরায়ণ, আবাসন খাতের বিস্তার এবং সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো এ খাতকে প্রবৃদ্ধির ধারায় নিয়ে আসে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, উড়ালসড়কের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এ শিল্পে প্রায় প্রতি বছরই দ্বিগুণ অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
যদিও বর্তমানে বাজারে মন্দা চলছে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশের ইস্পাত খাতের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার এখনো অনেক কম, প্রতি ব্যক্তি মাত্র ৪৩ থেকে ৪৫ কেজি, যেখানে ভারতে ৮১ কেজি এবং উন্নত দেশগুলোয় ৪০০ কেজির বেশি। ফলে প্রবৃদ্ধির সুযোগ এখনো বিশাল।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ইস্পাতের বার্ষিক চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টনে পৌঁছাতে পারে। সরকারের অবকাঠামোগত প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেলসহ নগরায়ণ ও আবাসন খাতের প্রসার এ চাহিদা বাড়াতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। স্বল্পমেয়াদি অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারলেই এ খাত দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।