রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ। আমাদের নিজস্ব পরিচিতি। ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে দাঁড়িয়ে কখনো ভাবতে পারিনি—একটি সময় আসবে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নারী খেলোয়াড়দের মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে মেতে উঠবে পুরো দেশ গভীর আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে।
আমাদের জন্য তখনকার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের চিন্তা মাথায় না আসাটা অস্বাভাবিক নয়। আমরা পূর্ব বাংলার বাঙালিরা প্রথমে ব্রিটিশ, এরপর ২৪ বছর পাকিস্তানের অধীনস্থ ছিলাম। আমাদের চিন্তাভাবনা এবং স্বপ্ন সব কিছুই অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা পাকিস্তানে প্রথম থেকেই সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত ও বঞ্চিত হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনও এর বাইরে নয়। ১৯৪৯ সালের ১ মে ‘বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট অব পাকিস্তান’ গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ নিয়ে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই সভায় যোগ দেওয়ার জন্য কোনো প্রতিনিধি চাওয়া হয়নি। শুরু থেকেই ক্রিকেটে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বাঙালি ক্রিকেটাররা।
তার প্রমাণ হলো ২৪ বছরে একজন বাঙালিও টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাননি, অথচ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বিভাগ, জেলা এমনকি মহকুমা শহরেও ক্রিকেটের চর্চা ছিল। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে বালক, কিশোর, তরুণ ও যুবকরা প্রতিটি মৌসুমে নেমে পড়তেন ক্রিকেটের ব্যাট-বল নিয়ে নিজ নিজ এলাকায়।
আদর্শ প্রস্তুতি ছাড়া ক্রিকেট বিশ্বকাপে নারী দলঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইভেন্টগুলো সব সময় উৎসবে রূপ নিয়েছে। সেই ষাটের দশকে আমার স্কুলজীবনের দিনগুলোতে পুরুষদের পাশাপাশি নারী দর্শককেও দেখেছি গ্যালারিতে উপস্থিত হয়ে খেলা দেখতে। ক্রিকেট দেখার প্রতি নারীদের উৎসাহ লক্ষ করে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান এবং আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে খেলার সময় প্রথম ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে নারীদের জন্য পৃথক ‘এনক্লোজারের’ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রীড়াঙ্গনকে শূন্য থেকে পূর্ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। ক্রীড়াঙ্গন ঘিরে অন্য এক ধরনের আবেগ প্রথম থেকেই কাজ করেছে।
নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম আয়োজন ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে। প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড আর রানার্স আপ অস্ট্রেলিয়া। নারীদের বিশ্বকাপ শুরুর দুই বছর পর আইসিসি পুরুষদের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ড। ক্রিকেট বিশ্বায়নের লক্ষ্যে নারী ও পুরুষ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজন আইসিসির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। খেলা হিসেবে ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি মেয়েদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ এবং উৎসাহ ছিল। তবে মাঠে নেমে খেলার চর্চা ছিল সামাজিক রীতিনীতির পরিপন্থী। একটি সময় থেকে এই প্রতিবন্ধকতার বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়েছে মেয়েরা। ক্রিকেট মাঠে এসে দেশকে তাঁরা সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেন। ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক কূপমণ্ডূকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। রক্ষণশীলরা বুঝতে পেরেছেন পরিবর্তন দেশের জন্য ইতিবাচক। চোখ বন্ধ নয়, চোখ খুলে তাকাতে হবে। সময়ের চাহিদা বুঝতে হবে।
অফিশিয়ালি ২০০৭ সাল থেকে নারী ক্রিকেটে যে জার্নি শুরু হয়েছে এ ক্ষেত্রে প্রাপ্তি কিন্তু নেহাত কম নয়। সঞ্চয় আরো বাড়ত যদি নারী খেলোয়াড়রা চলার পথে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা পেতেন। ‘প্রটেকশন’ পেত বিত্তবান ক্রিকেট বোর্ড এবং সরকারের তরফ থেকে। দেশজুড়ে ক্রিকেট চর্চা থেকে শুরু করে নারীদের একান্ত প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে চরম অবহেলা, উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আসন্ন নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে নারী দল দ্বিতীয়বারের মতো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এর জন্য ভালো প্রস্তুতি সবচেয়ে জরুরি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় নারী দল সেই সুযোগ পায়নি। পায়নি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে নিজের সবলতা এবং দুর্বলতা যাচাইয়ের। নারী দলের ভরসা গত এপ্রিলে পাকিস্তানে কয়েকটি ম্যাচ খেলে আসন্ন বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের সেই অভিজ্ঞতা। বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী আটটি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ নারী দল ছাড়া প্রত্যেকে দ্বিপক্ষীয় এবং ত্রিপক্ষীয় সিরিজ খেলে নিজেকে শানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নারীদের কথা ভাবার ফুরসত হয়নি। প্রেসিডেন্ট, পরিচালক, নারী দলের প্রধান ভীষণ ব্যস্ত নিজের নির্বাচন নিয়ে। ‘মসনদ’ থেকে বিদায় মানে তো সব শেষ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের নাটক মঞ্চস্থ আর ভণ্ডামির এখন শেষ নেই। উদ্যমী নারী ক্রিকেটাররা ঠিকই দেশের জন্য লড়বেন। অধিনায়ক বলেছেন ভালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হলে আত্মবিশ্বাস আরো দৃঢ় থাকত। চেষ্টা করব এবার কমপক্ষে দুটি দেশের বিপক্ষে জয় নিয়ে দেশে ফিরতে।
সামাজিক বাধাবিপত্তি এবং একদলের ‘লাল চোখ’ উপেক্ষা করে লড়ে চলেছেন—এটি তাঁদের মনের জোর, আত্মবিশ্বাস, খেলার প্রতি ভালোবাসা এবং দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য। নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া মহাদেশে (নারী এশিয়ান কাপে) চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এশিয়ান গেমসে এবং আঞ্চলিক গেমস (সাফ গেমসে) কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। প্রথমবার (২০২২) নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় লাভ। সাউথ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়—এ সবই তো দেশের জন্য। এর পরও নারীরা বারবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এখনই সময় চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নারী ক্রিকেটকে আলোকিত বন্দরে নিয়ে নোঙর করা। নারী ক্রিকেট ঘিরে বৈষম্য বন্ধ করা এবং দেশের ক্রিকেটে সমতা নিশ্চিত করা
নারী ক্রিকেটাররা মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও কেউ কেউ আবার ক্রিকেটের সান্নিধ্যে থেকে গেছেন। ক্রিকেটকে ‘সার্ভ’ করছেন কোচ, আম্পায়ার, সিলেক্টার, মেন্টার এবং সংগঠক হিসেবে। সাথিরা জাকির জেসী জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর আম্পায়ারিংয়ে এসেছেন। এর মধ্যেই দ্বিপক্ষীয় সিরিজ এশিয়া কাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ছেলেদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত আসন্ন ১৩তম ওয়ানডে নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এবারই প্রথমবারের মতো পুরো বৈশ্বয়িক টুর্নামেন্ট পরিচালনা করবেন শুধু ১৪ জন নারী আম্পায়ার এবং চারজন নারী ম্যাচ রেফারি। আইসিসি এই উদ্যোগ ক্রিকেটবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এটি বিশ্ব নারী ক্রিকেটে নতুন একটি অধ্যায়ের জন্ম দিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করবেন নারী আম্পায়ার সাথিরা জাকির জেসী। এটি তো জাতির আরেকটি প্রাপ্তি।
সালমা খাতুন প্রাক্তন জাতীয় দলের অধিনায়ক। অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটারের হাত ধরে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নারী দলের ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে যথাক্রমে ২০১১ ও ২০১২ সালে। সালমা খাতুন জাতীয় নারী দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৬টি ওয়ানডে এবং ৯৫টি টি-টোয়েন্টিতে। সালমা খাতুনকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নারী দলের সিলেক্টার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। পুরুষ নির্বাচক সাজ্জাদ আহমেদ শিপনও তাঁর সঙ্গে কাজ করবেন।
নিগার সুলতানার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ স্কোয়াড এখন কলম্বোতে অবস্থান করছেন। আট দেশ নিয়ে ১৩তম ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে আজ (৩০ সেপ্টেম্বর) ভারতের গুয়াহাটিতে। আর ফাইনাল ম্যাচ ২ নভেম্বর। তবে যদি পাকিস্তান ফাইনালে উঠে, তাহলে ম্যাচের ভেন্যু পরিবর্তন হয়ে তখন খেলা হবে কলম্বোয়। আসন্ন ওয়ানডে নারী বিশ্বকাপের প্রাইজমানি অনেক বেড়ে গেছে—আগের তুলনায়। যে আটটি দল অংশ নেবে তারা প্রত্যেকে দুই লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড করে পাবে পার্টিসিপেশন মানি। নারী বিশ্ব ওয়ানডে ক্রিকেটে এবার দেখা যাবে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে। এই দলটি বিশ্বকাপের চূড়ান্ত রাউন্ডে কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
বাংলাদেশ দল গত পাঁচ মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি এটি আগেই উল্লেখ করেছি। অধিনায়ক নিগার সুলতানা আশা করেছিলেন, কলম্বো পৌঁছে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে নিজেদের কিছুটা ঝালাই করে নেবেন—সেটিতে বাদ সেধেছে বৃষ্টি। খেলা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। বাংলাদেশ স্কোয়াডে সাতজন আছেন, যাঁরা গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ (নিউজিল্যান্ড) স্কোয়াডে ছিলেন। বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচ খেলবে ২ অক্টোবর পাকিস্তানের বিপক্ষে কলম্বোতে। গত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নারী দল পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিল। এবারও লক্ষ্য তাদের পরাজিত করা। পাশাপাশি স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকেও। উপমহাদেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কায়) উইকেটে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। উইকেটে আচরণ সংগতভাবেই একটু ভিন্ন ধরনের হবে। বাংলাদেশের বোলিং শক্তি হলো স্পিন আক্রমণ। পেস আক্রমণে বাংলাদেশ দল দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দলে পুরনো এবং নতুন মিলিয়ে কয়েকজন অলরাউন্ডার আছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময়মতো জ্বলে ওঠা। যে বিষয়টি ভাবাচ্ছে সেটি হলো প্রতিটি ম্যাচে রান করতে হবে। ব্যাটাররা রান করতে না পারলে বোলাররা যত ভালোই বোলিং করুন না কেন, তার ফল পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচ খেলবে ৭ অক্টোবর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের গুয়াহাটিতে। এ ক্ষেত্রে আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশ নারী দলকে শ্রীলঙ্কা ও ভারত উভয় দেশের ভেন্যুতে ক্রিকেট খেলতে হবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফিক্সচার অনুযায়ী। ইংল্যান্ডের পর নারী দল নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের বিপক্ষে খেলবে যথাক্রমে ১০, ১৩, ১৬, ২০ ও ২৬ অক্টোবর। দীর্ঘ সময় ধরে একটির পর একটি ম্যাচ। এ ক্ষেত্রে ছন্দ ধরে রাখার পাশাপাশি মনঃসংযোগ এবং ফিটনেস ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রিকেট উপভোগ করা। আর ক্রিকেটের বাইরে ছোটাছুটি না করা।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া