দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করেছে বিদেশি ছাত্রছাত্রী। কয়েক বছর আগেও বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আসতেন বাংলাদেশে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন পীঠস্থান ছিল তাদের আগ্রহের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ৪৯৮ জন বিদেশি শিক্ষার্থী কমেছে। আর প্রায় প্রতি বছরই কমে আসছে ভিনদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিং-রেপুটেশনে পিছিয়ে থাকছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও কমছে। আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান পেছনে থাকা, গবেষণায় পিছিয়ে পড়া, শিক্ষার গুণগত মান কমে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ, তুচ্ছ কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ আরও কিছু কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে বলে মনে করেন তাঁরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন আর সহিংসতার ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে না পারলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আরও মুখ ফিরিয়ে নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট হালনাগাদ না থাকা, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত আবাসনসুবিধা না থাকাকেও এর কারণ মনে করেন শিক্ষাবিদরা। ইউজিসির সর্বশেষ ৫০তম বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৬৭০ জন। এক বছর পর ২০২৩ সালে সেটি কমে ৬৩৩ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০১৮ সালে সরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ৮০৪ জন শিক্ষার্থী ছিল। ২০২০ সালে ছিল ৭৬৭ জন। আর ২০২১ সালে বিদেশি ছাত্রছাত্রী ছিল ৬৭৭ জন। ইউজিসির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য হারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে। ২০১৭ সালে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ১ হাজার ৯২৭ জন। ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৮৬ জনে। ২০২২ সালে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৮৭ জনে। আর ২০২৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি ছাত্রছাত্রী ছিল ৮২৬ জন। তথ্যমতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৬৬ জন। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯১, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১২ জন বিদেশি অধ্যয়নরত ছিল। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক পরিবেশ ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন হয়নি। শিক্ষায় আশানুরূপ বিনিয়োগ হয়নি, শিক্ষকরা যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না।’ তিনি বলেন, ‘উচ্চশিক্ষার মানে গুণগত পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারবে।’ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনসুবিধা থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য তেমন আবাসনসুবিধা নেই। এ ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আউটকাম বেইজড এডুকেশন এখনো কার্যকর করা যায়নি। এটি শুধু কার্যকর নয়, বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট দেখে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট নিয়মিতভাবে আপডেট করা হয় না। সেখানে শিক্ষকদের তথ্যও হালনাগাদ করা হয় না। বিদেশি শিক্ষার্থী টানতে সরকারের পক্ষ থেকেও পদক্ষেপ নিতে হবে।’