আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই জুলাই বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লক্ষ্য ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়া। গত চার মাসে অর্ধশতাধিক আসনে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রিক সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে। এসব আসনে প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত। দলের নেতারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বাকি আছে আর মাত্র সাত মাস। ৩০০ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার মতো যোগ্য প্রার্থী দিতে এনসিপি কাজ করছে বলে জানা গেছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনসিপি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে আমরা তখন সেগুলো মোকাবিলা করব। তিনি বলেন, এনসিপির মূল লক্ষ্য গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখা। বর্তমানে জুলাই গণহত্যার বিচার, শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, মৌলিক সংস্কার এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়ায় দলটির নেতারা দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন। এতে নিজ নিজ এলাকায় গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তাদের প্রভাব তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও এনসিপির জেলা ও উপজেলার নেতৃত্বে আসতে চান, এমন অনেকেও নির্বাচনে আগ্রহী। এনসিপির নেতাদের মধ্যে কয়েকজন রাজধানী ঢাকায় নির্বাচন করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ ইসলামের বাড়ি ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীতে। তিনি ঢাকা-১১ আসনে নির্বাচন করতে পারেন। বাড্ডা, ভাটারা, রামপুরা, বনশ্রী এলাকা (ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২১, ২২, ২৩, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ড) নিয়ে গঠিত হয়েছে এই আসনটি।
ঢাকা-১৭ (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা) আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনীম জারা। শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে তাকে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় প্রার্থী করার আলোচনা রয়েছে।
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম সারির নেতা হিসেবে তিনি এই আসনে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন এলাকার বিভিন্ন সভা-সেমিনারে।
উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম প্রার্থী হবেন পঞ্চগড়-১ আসনে। পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনের ভোটারদের সঙ্গে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তিনি।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এনসিপির যারা নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় হয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই নিজ এলাকা নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে বেশ সক্রিয় হন তিনি। এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি কাজ করছেন বিভিন্ন স্থানীয় সমস্যা সমাধানেও।
দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন পীরগাছা ও কাউনিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত রংপুর-৪ আসনে প্রার্থী হতে পারেন। নির্বাচনি এলাকায় প্রায়ই জনসংযোগ চালাচ্ছেন তিনি।
ভোলা সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত ভোলা-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। গত কয়েক মাসে ভোলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। তবে ঢাকা-৯ আসনেও তাকে প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলের ভিতর আলোচনা রয়েছে। নিজ এলাকা বরিশাল-৪ কিংবা ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এনসিপির আরেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। ঢাকা-১৪ আসনটি ঢাকার উত্তর সিটির ৭ থেকে ১২ নম্বর ওয়ার্ড ও সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ঢাকা-৬ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন দলের যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মুহাম্মদ মুরসালীন।
যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীনকে ভোটের মাঠে দেখা যেতে পারে ঢাকা-১২ অথবা নোয়াখালী-২ আসনে। বরগুনা-১ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন যুগ্ম সদস্য সচিব ফয়সাল মাহমুদ শান্ত। ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর) আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন যুগ্ম সদস্য সচিব আকরাম হুসাইন। যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার নরসিংদী থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী। নরসিংদী-২ আসন কেন্দ্রিক তৎপরতা তার বেশি। তবে সম্প্রতি নৈতিক স্খলনের দায়ে তাকে সাংগঠনিক কার্যক্রমে অব্যাহতি দিয়েছে দল।
হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলা নিয়ে গঠিত চাঁদপুর-৫ আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম দৌলতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-১ আসনে প্রার্থী হতে চান। সেই লক্ষ্যে এলাকার মানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়াচ্ছেন তিনি। এলাকার বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুব আলম মাহির লক্ষ্মীপুরে নির্বাচন করতে পারেন।
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এস এম শাহরিয়ারের পরিবার ঢাকা-৫ (ডেমরা) আসনে আগে থেকেই রাজনীতিতে জড়িত। যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন ঢাকা-৯ এবং সংগঠক মো. রাসেল আহমেদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন ঢাকা-১ থেকে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দীন মাহাদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি এ আসনেরই সাবেক এমপি মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নাতি। আশরাফ মাহাদী কওমি ধারা থেকে আসা নেতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে কওমি মাদরাসাগুলো প্রভাবশালী। যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অনিক রায় সুনামগঞ্জ-২ থেকে নির্বাচন করবেন। যুগ্ম সদস্য সচিব প্রীতম দাশ মৌলভীবাজার থেকে নির্বাচন করবেন। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ ছেড়ে দলের যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন। ঢাবি শিবিরের সাবেক এই সেক্রেটারি পটুয়াখালী-২ (বাউফল) থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি জামায়াত নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদের আত্মীয়। যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আলী নাছের খান গাজীপুর-১ আসনে প্রার্থী হতে চান। যুগ্ম সমন্বয়কারী আরিফুর রহমান তুহিন ঝালকাঠি-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুড়িগ্রাম-১ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে এলাকায় সময় দিচ্ছেন যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ।
টাঙ্গাইল-১ মধুপুর আসনে নির্বাচন করবেন দলের মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ। আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ আগে থেকেই মধুপুরে নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় আছেন। উল্লেখযোগ্য গারো জনগোষ্ঠীর ভোট ব্যাংক থাকায় তিনি ভালো সমর্থন পেতে পারেন।
যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু খুলনা-১ এবং নওগাঁ আসনে কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস নির্বাচন করবেন। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত সম্প্রদায়ের ভোটে তারা এগিয়ে থাকতে পারেন।
এ ছাড়াও যুগ্ম সদস্য সচিব মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান চুয়াডাঙ্গা-১, আবু সাঈদ সুজাউদ্দীন কক্সবাজার, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাইফুল্লাহ হায়দার টাঙ্গাইল-৩, মেজর (অব.) আবদুল্লাহ মাহমুদ খান গাজীপুর-৩, মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিওন নীলফামারী-৩, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ডা. মাহমুদা মিতু বরিশাল-৫, সংগঠক আবদুল্লাহ আল মামুন ফয়সাল ভোলা-৪ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।