দুই মাস আগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে থাইরয়েড ক্যানসারের সার্জারি করিয়েছেন টাঙ্গাইলের সীমা রহমান। তিনি বলেন, ‘সার্জারির পর চিকিৎসকরা বলেছেন রেডিওআয়োডিন থেরাপি নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসে (নিনমাস) যোগাযোগ করে ওষুধ পাচ্ছি না। এ ছাড়া দেশের অন্য নিউক্লিয়ার মেডিসিন ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়েছি কিন্তু সবাই বলছেন ওষুধের সরবরাহ নেই। ফার্মেসি বা অন্য কোথাও এ ওষুধ মিলছে না। ক্যানসার ফিরে আসার ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।’
চিকিৎসকরা জানান, দেশে পরমাণু শক্তি কমিশন বিদেশ থেকে রেডিওআয়োডিন আইসোটপ আমদানি শেষে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় সরবরাহ করে। দেশে ২৪টি পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রের মাধ্যমে রেডিওআয়োডিন থেরাপি দেওয়া হয়। থাইরয়েডের অপারেশন করা রোগীদের তারা নিবন্ধন শেষে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। রোগীর সার্বিক অবস্থা যাচাই করার পর এ ওষুধটা খাওয়ানো হয়। এ সময় রোগীকে হাসপাতালে পাঁচ দিন একটি আবদ্ধ ঘরে থাকতে হয়। যেখানে কেউ প্রবেশ করে না। কারণ আইসোটপটা বিকিরিত হয়। ওই কক্ষে কেউ প্রবেশ করলে তিনিও রেডিয়েশনে আক্রান্ত হতে পারেন। আইসোটপ খাওয়ানো, হাসপাতালে থাকাসহ ২৫-৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয় রোগীর। কিন্তু সরকারিভাবে ওষুধের আমদানি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন রোগীরা।
জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু হানিফ বলেন, ‘প্রায় ছয় মাস ধরে রেডিওআয়োডিন সংকটের কথা জানাচ্ছেন রোগীরা। এ আইসোটপ আমদানি করে পরমাণু শক্তি কমিশন কিন্তু এর ভুক্তভোগী স্বাস্থ্য খাতের রোগী ও চিকিৎসকরা। রোগীরা আমাদের কাছে নিয়মিত ওষুধের বিষয়ে জানতে চাইছেন। এ ওষুধ আমদানির সংকট সমাধানে আমি স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সহকারীর সঙ্গে কথা বলেছি। পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগাযোগ করেছি। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হওয়া খুব জরুরি।’ এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘রেডিওআয়োডিন আইসোটপ সংকটের বিষয়ে আমরা জেনেছি। যদিও ওষুধটি আমদানির বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়, তবে সমস্যাটা যেহেতু রোগীদের তাই আমরা এ বিষয়টি দ্রুত সমাধানে পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগাযোগ করব।’
দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর আনুমানিক ৬ থেকে ৮ হাজার নতুন থাইরয়েড রোগী শনাক্ত হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক, থাইরয়েড সার্জন ডা. আবদুল করিম বলেন, ‘ক্যানসার চিকিৎসা একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। অপারেশন সফল হলেও রেডিওআয়োডিন থেরাপি না পেলে রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায় না। এ ঘাটতি রোগীদের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসা সম্পূর্ণ না হলে তার ক্যানসার পুনরায় ফিরে আসতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে ৩০-৪০ শতাংশ রোগীর এ রোগ ফিরে আসে যদি রেডিওআয়োডিন না দেয়। নিয়ম হলো অপারেশনের চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে রেডিওআয়োডিন দিতে হবে। প্রায় ছয় মাস ধরে এ সংকট চলছে। রোগীদের পাশের পরমাণু কেন্দ্রে যেতে বলছি কিন্তু তারা ফিরে এসে জানাচ্ছেন ওষুধ পাচ্ছেন না।’
চিকিৎসকরা বলেন, থাইরয়েড ক্যানসারের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির প্রয়োজন নেই, রেডিওআয়োডিন খেতে হয়। রেডিওআয়োডিন থেরাপি দিতে দেরি হলে থাইরয়েড গ্লান্ড থেকে ক্যানসার শরীরের অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
ফেসবুকভিত্তিক সক্রিয় রোগী সহায়তা কমিউনিটি ‘থাইরয়েড সাপোর্ট গ্রুপ’-এর অ্যাডমিন ফারজানা হাফিজ জানান, প্রতিদিন বহু রোগী পোস্ট করে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, বিকল্প চিকিৎসার উপায় জানতে চাইছেন। কেউ কেউ বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সংকট শুধু চিকিৎসা নয়, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।’