পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা দিনকে দিন বাড়ছে। বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ- ভিসা করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছেন সবুজ পাসপোর্টধারীরা। বাইরের দেশের ভিসা পাওয়ার জটিলতা বাংলাদেশিদের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু গত জুলাই আন্দোলনের পর থেকে এই ভিসা জটিলতা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ভিসা পাওয়ার পরও অনেক বাংলাদেশিকে শুধু সন্দেহ হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন স্পটগুলোতেও বিড়ম্বনার শেষ নেই। হোটেল-রিসোর্টের মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, নিরাপত্তাহীনতা, পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাব, তদুপরি একের পর এক দুর্ঘটনা- ভ্রমণে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করছে। ফলে দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশি পর্যটকদের ইতিবাচক আগ্রহ থাকলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের পৃথিবী দেখার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে।
এ অবস্থার মধ্যেই আজ পালিত হবে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘টেকসই উন্নয়নে পর্যটন’। দেশের ট্যুর অপারেটর ও পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে বিশ্ব ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। কেবল দেশের কাছে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তারা। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে পর্যটক হিসেবে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডা তো বটেই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশও এখন বাংলাদেশিদের সহজে ভিসা দিতে চাচ্ছে না। যারা পাচ্ছেন- তাদেরও ভিসা পেতে নানান জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এ ছাড়া আগে বেশ কিছু দেশ বাংলাদেশি নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা সেবা দিলেও এখন সেসব দেশও তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশিদের বহির্বিশ্বে ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দুবাই, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান ও কাতার বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ইন্দোনেশিয়া আগে অন অ্যারাইভাল ভিসা দিলেও কয়েক বছর ধরে সেটিও বন্ধ। কম্বোডিয়ার ভিসা প্রক্রিয়াও এখন আর সহজ নয়। দূরত্ব কম হওয়ায় এবং সাশ্রয়ে ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি যেতেন পাশের দেশ ভারতে। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে দেশটি বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রেখেছে। চীনে এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হলেও চীনের বিমানবন্দর থেকেও সন্দেহ হলে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। থাইল্যান্ডে চলতি বছরের মে মাসের পর ভিসা পাওয়ার হার সামান্য বাড়লেও যাচাইবাছাইয়ের কারণে ভিসা পেতে সময় বেশি লাগছে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন থেকেও সন্দেহ হলে অনেককে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
ইউনাইটেড কনসালটেন্সি অ্যান্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী শেখ কামরুজ্জামান রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভিসাপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশিদের অবস্থা আগেও ভালো ছিল না। তবে জুলাই আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর ভিসা পাওয়ার বিষয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। ভিসা পাওয়ার জটিলতা আগে এত প্রকট ছিল না। এখন এই জটিলতা চোখের পড়ার মতো। বাংলাদেশি পর্যটকদের কাগজ এখন অতিরিক্ত যাচাইবাছাই হচ্ছে। আগের চেয়ে অতিরিক্ত কাগজপত্র জমাও দিতে হচ্ছে। ভিসা পেতে সাধারণ সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় লাগছে। এ ছাড়া অনানুষ্ঠানিকভাবে যেসব দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা নিয়ে ঝামেলা করছে- তাদের ইমিগ্রেশন দেখাচ্ছে যে, বাংলাদেশি পর্যটকরা ট্যুরিস্ট ভিসার নিয়ম ভাঙছেন। প্রচুর পরিমাণ মানুষ ভিসার উল্লিখিত সময়ের পরও ঘুরতে যাওয়া দেশে থেকে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দূতাবাসে বাংলাদেশিরা ভুয়া কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। এজন্য দূতাবাসগুলো এখন কাগজ যাচাইবাছাই করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে যারা সত্যিকারের পর্যটক তাদের ভিসাও দিচ্ছে না। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও ওইসব দূতাবাসগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কার্যকর সমন্বয় করা হচ্ছে না।
পর্যটন ব্যবসায় জড়িতরা জানান, কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন লাইন যুক্ত হওয়ায় সেখানকার নতুন নতুন ঝরনা-ঝিরিসহ পাহাড় ও সমুদ্রে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। কিন্তু পর্যটকদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ, কক্সবাজার, সিলেটসহ দেশের পার্বত্য এলাকার হোটেল- রিসোর্টগুলোর রুম ভাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার হোটেল রুমের চেয়েও বেশি। এমনকি সেখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারের মান অনুযায়ী দাম বেশি। পর্যটন মৌসুম- শীতকালে এবং ঈদের ছুটিতে পর্যটন স্পটগুলোতে থাকার রুম পর্যন্ত পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন স্পটগুলোতে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাবে পর্যটকদের আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজার সৈকতে প্রায়ই সমুদ্রে পর্যটকদের ডুবে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সৈকতে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ প্যারাসেইলিং বন্ধ করে দেয়। সমুদ্রে রাতের বেলা অনেক নারী পর্যটককে হয়রানির শিকার হতে হয়।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর সভাপতি মোহাম্মদ রাফিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের হোটেল-রিসোর্টগুলোর রুম ভাড়া অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি এ কথা ঠিক। বাংলাদেশে হোটেল ও রিসোর্ট, পার্ক বা ক্রুজ তৈরি করতে যে যন্ত্রাংশ লাগে তার অধিকাংশই আমদানি করতে হয়। এর ডিউটি ফি অনেক বেশি। এতে নির্মাণ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগকারী হোটেল-রিসোর্টের রুমের ভাড়া বেশি ধরেন। আবার কোনো কোনো পর্যটন স্পটে চাহিদার তুলনায় হোটেল-রিসোর্ট কম। এতে স্বাভাবিকভাবে রুমের ভাড়া বেড়ে যায়। এ বিষয়গুলো সরকারের রেগুলেটরি কমিশনকে নজরদারি করতে হবে। আর বাংলাদেশ থেকে যারা পশ্চিমা দেশে যাচ্ছেন তারা ভিসা পাচ্ছেন না কেন তার জন্য অ্যাডভোকেসি বা কূটনৈতিক মিশন দিয়ে কাজ করানোর এখতিয়ার সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।