‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ! এরপর সত্যপথে অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতারা এসে বলে, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তা কোরো না; তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সে খোশখবর শুনে আনন্দিত হও।’ (সুরা হামিম আস সাজদাহ, আয়াত ৩০)। বেহেশতের খোশখবর পাওয়ার জন্য আয়াতে দুটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত ঘোষণা করতে হবে ‘আমাদের প্রভু আল্লাহ।’ আল্লাহ ছাড়া আর কারও প্রভুত্ব স্বীকার করা যাবে না। দ্বিতীয়ত এই ঘোষণার ওপর অটল-অবিচল থাকতে হবে। মুফাসসিরগণ বলেন, মক্কায় কাফের-মুশরেক নির্বিশেষে সবাই আল্লাহকে প্রভু বলে স্বীকার করত। কিন্তু তারা তাদের সে ঘোষণার ওপর অটল থাকতে পারেনি। বরং তারা তাওহিদের সঙ্গে শিরকও মিশিয়ে ফেলেছিল। মুফাসসিরকুল শিরোমনি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সাইয়েদেনা আবু বকর (রা.) ছিলেন ব্যতিক্রম। হজরত আবু বকর (রা.) যেভাবে ইমানের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সে ঘোষণায় অটল ছিলেন তা আল্লাহপাকের খুব পছন্দ হয়েছে। সিদ্দিকে আকবরের অতুলনীয় ইমানের ঘোষণা ও অবিচলতাকে কেন্দ্র করেই নাজিল হয়েছে সুরা সাজদাহর ৩০ নম্বর আয়াত।’ (তাফসিরে কুরতুবি, ১৫তম খণ্ড, ৩৫৬ পৃষ্ঠা; সাফওয়াতুত তাফাসির, ৩য় খণ্ড, ১৬৪ পৃষ্ঠা।)
আলোচ্য আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে আল্লামা ইমাদুদ্দিন (রহ.) নিজের তাফসিরে লিখেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ’ এর মানে হলো মুখে ইমানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং ইমানের সঙ্গে শিরক মিশিয়ে না ফেলা। ‘সত্যপথে অবিচল থাকে’ এর অর্থ হলো আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা। আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা হালাল মনে করা। যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করা। আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ পালন করা এবং তার নিষেধ থেকে দূরে থাকা। এভাবে যে ব্যক্তি জীবন পরিচালনা করতে পারবে তাদের কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তাও নেই। মুসনাদে আবু ইয়ালা এবং সুনানে নাসায়ির সূত্রে এসেছে, রসুল (সা.) আয়াতটি তেলাওয়াত করে বলেন, ‘অনেক মানুষই আছে আল্লাহকে প্রভু বলে ঘোষণা করার পর সে ঘোষণার ওপর আর অটল থাকতে পারে না। তাদের জন্য কোনো খোশখবর নেই। বরং যারা ইমান এনে তার ওপর অটল থেকেছে তারাই আল্লাহর ওয়াদা জান্নাতের সুসংবাদ পাবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, ১৬ খণ্ড, ৪৭৮ পৃষ্ঠা।) ‘তাদের কাছে ফেরেশতারা এসে বলে’- অর্থাৎ যখন মুমিনদের মৃত্যুর সময় চলে আসে তখন তাদের চোখ খুলে যায়। তারা সরাসরি ফেরেশতাকে দেখতে পায় এবং ফেরেশতাদের কথা শুনতে পায়। ফেরেশতারা তাদের তিনটি বিষয়ে সুসংবাদ দেয়। প্রথম সুসংবাদ হলো, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না।’ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুমিন বান্দার প্রথম ভয় আখেরাতের জীবন তার কেমন হবে এই সম্পর্কিত। কবরের জীবন তার কেমন হবে? হাশরের দিন কী হবে? অন্ধকার কবরে কীভাবে থাকবে? এই ভয় তার মনে জড়ো হয়। ফেরেশতারা তাকে অভয় দিয়ে বলে, হে আল্লাহর বান্দা! দুনিয়ার রং তামাশা ভুলে, শত প্রলোভন এড়িয়ে সাহসের সঙ্গে তুমি ঘোষণা করেছিলে ‘আমাদের প্রভু আল্লাহ!’ শুধু ঘোষণাতেই তুমি থেমে থাকোনি। ‘এরপর সত্যপথে অবিচল থেকেছ।’ সুতরাং আগত আখেরাতের দিনগুলো নিয়ে, কবরের রাতগুলো নিয়ে ‘তোমার কোনো ভয় নেই।’
আখেরাতের ব্যাপারে নির্ভয় হওয়ার পর তার মনে এখন নতুন চিন্তা দেখা দেয়। দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত কিছু দায়িত্ব তার ওপর আছে। তার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে, বাবা-মা আছে, ব্যবসাবাণিজ্য আছে। এখন সে নির্ভয় হয়ে আখেরাতের পথে রওনা করেছে, তার স্ত্রীর কী হবে? সন্তানের কী হবে? বাবা-মাকে কে দেখবে? এসব চিন্তার বলিরেখা তার কপালে ফুটে ওঠে। ফেরেশতারা বুঝতে পেরে বলেন, ও আল্লাহর বান্দা! ‘চিন্তা কোরো না।’ তোমার অবর্তমানে তোমার স্ত্রী-সন্তান সবার দায়িত্ব আল্লাহর। তোমার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ছেলের উচ্চশিক্ষাও চলবে। স্ত্রীর সম্ভ্রমও বজায় থাকবে। তোমার যাবতীয় কাজ সমাপ্তের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়ে নিয়েছেন। আখেরাতের ভয় নেই। দুনিয়ার জীবন নিয়ে চিন্তা নেই। এখন মুমিন বান্দার মনে অনাবিল আনন্দ। ফেরেশতা তাকে তৃতীয় ও সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত খোশখবর শোনায়- ও আল্লাহর বান্দা! দুনিয়ার জীবনে কত কষ্ট করেছ। ইমানের পথে অবিচল থাকার কারণে কত নির্যাতন সহ্য করেছ। এখন আর কোনো কষ্ট নেই। কেউ তোমাকে নির্যাতন করবে না। তোমাকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আনন্দচিত্তে সে জান্নাতের খোশখবর শোনো। ফকিহ আবু লাইস সমরকন্দি (রহ.) বলেন, ইমানের স্তর অনুযায়ী মুমিনদের পাঁচ রকম খোশখবর শোনাবেন ফেরেশতারা। সাধারণ গোনাহগার মুমিনদের ফেরেশতারা বলবেন, তোমার সীমাহীন গোনাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। দুনিয়ায় যেসব নেক বান্দার সোহবতে ছিলে, নবীর মহব্বতে যে সময় ব্যয় করেছ, এর বদৌলতে সালেহিনরা ও দয়াল নবীজির সুপারিশক্রমে তোমাকে জান্নাতে পাঠানো হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট