সংসদ সচিবালয় ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির আলোচনার টেবিল থেকে জুলাই জাতীয় সনদ ইস্যু এখন রাজপথে। ২ শতাধিক বৈঠক আর ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ের পরও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে, একপথে আনতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ পরিস্থিতিতে জুলাই সনদ ইস্যু নিয়ে রাজপথে নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
বিষয়টি গড়ায় সরকার পর্যন্ত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পথ দেখানো হয়নি। ‘লাস্ট চান্স’ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে দলগুলোকে সম্মিলিত মতামত জানাতে এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। সময় শেষ হলেও তাতে সাড়া মেলেনি। উল্টো সরকারকে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে রাজপথে নেমেছে দলগুলো। সেখান থেকে সরকারকে নানা রকম আলটিমেটাম দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে জুলাই সনদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে আগামী নির্বাচন নিয়েও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গতকাল জুলাই সনদের অন্যতম স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার জামায়াতে ইসলামী রাজধানীর পল্টন মোড়ে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ জারি ও নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে সমাবেশ করে। সেখানে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, জুলাই সনদে জনগণের দাবির প্রতিফলন ঘটেছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত জনগণের দাবি পূরণ না করতে পারছি, ততক্ষণ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, যারা জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি দিতে নারাজ তাদের জন্য ২৬ এ কোনো নির্বাচন নাই। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির পাটাতন তৈরি হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে। আর জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না।
অন্যদিকে একইদিন জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখিত বিষয়ের বাইরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের জন্য তা মানার বাধ্যবাধকতা থাকবে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। একই বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে কোনো কোনো বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের ঘোষণার প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বিভ্রান্তিকর এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করার শামিল। সে ক্ষেত্রে সব দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে। এ ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
দলগুলোর এ ধরনের ভূমিকার মাঝে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে উপদেষ্টারা নিজেরা নিয়মিত আলোচনা করছেন বলে জানিয়েছেন সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাদের মতে, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একটি খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগামীকাল উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার কথা। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে চায়। আলোচনার টেবিল থেকে জুলাই জাতীয় সনদ রাজপথে যাওয়াকে কীভাবে দেখছেন-এ প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বইয়ের ভাষায় তিনটি ধাপ পেরিয়ে একটি দেশ সংঘাত বা সংঘর্ষের দিকে যায়। প্রথম ধাপ হচ্ছে কোন ইস্যু সামনে আসা, পরে সেটা নিয়ে দরকষাকষি, এরপর সংঘাত। পরিস্থিতি অনুযায়ী এখন দ্বিতীয় ধাপে অবস্থান করছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিকমুখিতার অভাব আছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এর মাঝে দলগুলো আবার মাঠে নামছে। এ নিয়ে আসলে তারা কি অর্জন করতে চাচ্ছে, গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করাটা বিলম্বিত করা কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আলোচনার টেবিল থেকে রাজপথে যাওয়ার বিষয়টি নতুন কোনো সংকটের শুরু কি না তা ভাবতে হবে। আলোচনার টেবিলে দলগুলোর যে মুড ছিল সেটা পরিবর্তন হয়েছে।