পাকিস্তান আমলে আমাদের স্বাধিকার সংগ্রামের স্লোগান ছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। পদ্মা মেঘনা যমুনা বাংলাদেশের তিন বড় নদীর নাম। আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের অনুষঙ্গ। ছোটবেলায় আমাদের পড়ানো হতো- এদেশ নদনদীর দেশ। আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, দুনিয়ার আর কোনো দেশে এত নদনদী নেই। এ ধারণা কতটা সত্যি, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও বাংলাদেশের নদনদী, খাল, হাওড়-বাঁওড় একদিক থেকে অনন্য। মিঠাপানির এমন সমৃদ্ধ ভান্ডার প্রকৃতই দুনিয়ার আর কোনো দেশে নেই। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু এ সম্পদ সম্পর্কে আমরা যত্নবান নই। নিজেদের সম্পদ সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ড নামের একটি শ্বেতহস্তি পোষা হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। তাদের একটি খসড়া হিসাবে বাংলাদেশের মোট নদনদীর সংখ্যা ১ হাজার ৪১৫। একই সংস্থার আরেক গবেষণায় এ সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের হিসাবে বাংলাদেশের মোট নদীর সংখ্যা ৪০৫। এর মধ্যে ৫৭টি অভিন্ন নদী।
বাংলাদেশকে যেমন বলা হয় পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গার দেশ, তেমন রাশিয়াকে বলা হয় ভলগা নদীর দেশ। রাশিয়ায় নদীর সংখ্যা কত, এ কথা জানলে অনেকেই ভিরমি খেতে বাধ্য। গুগলে সার্চ দিলে দেখা যাবে এ সংখ্যা অন্তত ১ লাখ। নদী নিয়ে গবেষণা আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আজকের আলোচ্য বিষয় রাশিয়ার ভলগা পারে অক্টোবরের রুশ বিপ্লব এবং সে বিপ্লবের অনুকরণে ৫৮ বছর পর, বাংলাদেশে সংঘটিত ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লব।
দুই.
আজ থেকে ১০৮ বছর আগে ভলগা নদীপারের দেশ রাশিয়ায় ঘটেছিল মহান অক্টোবর বিপ্লব। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যে বিপ্লবকে মার্কিন সাংবাদিক জন রিড অভিহিত করেছেন ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ হিসেবে।
দুনিয়ার ইতিহাসে মহান অক্টোবর বিপ্লব এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লব দুনিয়াজুড়ে স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির অবিস্মরণীয় চেতনার বিকাশ ঘটায়। এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় সর্বস্তরের মানুষ। স্বাধীনতার চেতনা বিকশিত হয় দেশে দেশে। মহান রুশ বিপ্লবের পর পুঁজিবাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। বেজে ওঠে উপনিবেশবাদের মৃত্যুঘণ্টা। যার ফলে একের পর এক দেশ থেকে সরে যান উপনিবেশবাদী শাসকরা। স্বাধীনতা অর্জন করে বেশ কিছু দেশ। রুশ বিপ্লবের দেখানো পথে গণচীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কিউবাসহ বিশ্বের প্রায় এক ডজনেরও বেশি দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক শ্রেণির রাজত্ব।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও জারশাসিত রাশিয়া ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। ইউরোপের বেশির ভাগ এলাকা ছিল তাদের দখলে। এশিয়ায়ও রুশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল বিশাল। ১৯০৪-১৯০৫ সালের যুদ্ধে জাপান রাশিয়াকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। প্রশান্ত মহাসাগরে রাশিয়ার নৌবহর নাস্তানাবুদ হয় জাপানি আক্রমণে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাপান বিপুলভাবে জয়ী হয়। এই জয়ে চীনের মাঞ্চুরিয়া ও কোরিয়ায় জাপানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফাঁস হয়ে পড়ে রুশ রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের দুর্বলতা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় সংঘটিত হয় প্রথম বিপ্লব। যা গণতান্ত্রিক বিপ্লব নামেও পরিচিত। জাপানের কাছে লজ্জাজনক পরাজয় রাশিয়ানদের অহংবোধে আঘাত হানে। অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ। ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে হাজার হাজার শ্রমিক বিভিন্ন দাবি আদায়ে ধর্মঘটে নামে। ফাদার গ্যাপো নামের এক নেতার নেতৃত্বে জার নিকোলাসের শীতকালীন প্রাসাদের সামনে তারা সমবেত হয় দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে। জারের নির্দেশে শ্রমিকদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে এক হাজারের বেশি শ্রমিক নিহত হন। এ শ্রমিক হত্যাকাণ্ড মানুষের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। জারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। বিপ্লবীদের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হন জার দ্বিতীয় নিকোলাস। রাশিয়ায় দুমা বা পার্লামেন্ট গঠনে রাজি হন তিনি। দুমা জারের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা বাতিলের ক্ষমতা পায়। ফলে মানুষের ক্ষোভ হ্রাস পায়। বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় রাজতন্ত্র। কিন্তু কথায় বলে স্বভাব সহজে বদলায় না। জার ও তার দোসররা বিপদ কাটতেই ফের ধরাকে সরা জ্ঞান করার পথে হাঁটে। জার নিকোলাস সুযোগ বুঝে দুমা ভেঙে দেয়। ফলে জার শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আগের চেয়ে বেড়ে যায়। শ্রমিক শ্রেণি জোরেশোরে সংঘটিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই বসনিয়ায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ। সার্ব জাতীয়তাবাদী এক যুবক এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ যুক্তিতে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সার্বিয়ার পক্ষ নেয় রাশিয়া। ফলে ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধে রাশিয়া বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ চালাতে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে অর্থনীতি। শ্রমিকদের জীবনজীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। কঠিন হয়ে ওঠে কৃষকদের জীবন। ঠিক এমন অবস্থায় রাশিয়ায় সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরের দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব। এ বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শ্রমিকরা। ‘মেহনতি মানুষের শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই’- এই মন্ত্রে জেগে ওঠে তারা। কারখানার বিপ্লবী শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্ম হন সেনাবাহিনী সদস্যরা। প্রথম মহাযুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল যাদের জীবন। বিপ্লবীদের হাতে জার শাসনের পতন ঘটে। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসে শ্রমিক শ্রেণির সরকার। তারা প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে সরে আসে। বিপ্লব ক্রমান্বয়ে সফল হয় জারশাসিত পুরো সাম্রাজ্যে অর্থাৎ আরও ১৪টি দেশে। যে দেশগুলোকে নিয়ে ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রায় ৬৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর গর্বাচেভের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। এই ঘটনা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানি, জাপান ও ইতালির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয়লাভে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জার্মানি ইউরোপের একের পর এক দেশ দখল করে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নে আগ্রাসন চালিয়ে প্রকারান্তরে নিজেদের বিপদ ডেকে আনে। প্রথম দিকে একের পর জনপদ দখল করে জার্মান বাহিনী। কিন্তু রেড আর্মির প্রচণ্ড প্রতিরোধে জার্মানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। জার্মানির রাজধানী বার্লিনসহ বৃহৎ অংশ নিজেদের দখলে আনে সোভিয়েত বাহিনী। জার্মান নাৎসি বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। পরাজয়ের লজ্জা এড়াতে হিটলার আত্মহত্যা করেন।
ইউরোপে জার্মান দখলকৃত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছয়টি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, পোল্যান্ড ও যুগোস্লাভিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর এসব দেশেও সমাজতান্ত্রিক শাসনের ইতি ঘটে।
তিন.
১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লবকে অনুসরণ করে, ৫৮ পর বছর পর একই ডেটলাইনে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব। এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামের সংগঠন। স্মর্তব্য স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগে ভাঙন ধরে। ছাত্রলীগের সিংহভাগ নেতা-কর্মী বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব তুলে, মূল দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ থেকে যায় মুজিববাদী আদর্শের অনুসারী হিসেবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী সাবেক ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশকারী প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। দলটি দ্রুত আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জাসদ দুটি সশস্ত্র উইং গড়ে তোলে। এর একটি হলো বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। যাদের কার্যক্রম ছিল সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে। জাসদ নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় বিপ্লবী গণবাহিনী। কর্নেল আবু তাহের ছিলেন দুটি সশস্ত্র সংগঠনের প্রধান।
কর্নেল আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ছিলেন পাকিস্তানে। সেখান থেকে পালিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১১নং সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে তাহের গুরুতর আহত হয়ে একটি পা হারান। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহসিকতার জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা সেনানিবাসের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্তি পান কর্নেল তাহের। ১৯৭২ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। এবং জাসদে যোগ দেন। তাহেরকে সশস্ত্র শাখার নেতৃত্বে রাখা হয়।
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর। পরবর্তী সময়ে দুনিয়ার অন্যান্য দেশের মতো সে দেশেও গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়। ২৫ অক্টোবর হয়ে যায় ৭ নভেম্বর। বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটনে ৭ নভেম্বর ডেটলাইন বেছে নেওয়া হয় রুশ বিপ্লবকে সামনে রেখে। এ বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি। ঢাকা সেনানিবাসের হাবিলদারবাড়ির স্টাফ কোয়ার্টারে। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জলিল ও কর্নেল তাহের। সেনাবাহিনীর জুনিয়র ও ননকমিশন্ড অফিসারদের একাংশ এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে গোপন বৈঠকে মিলিত হতো। তাতে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানও উপস্থিত থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টরে কর্নেল তাহেরের সহযোদ্ধা সৈনিকদের মধ্যে এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ব্যাপক প্রভাব ছিল।
৭ নভেম্বর বাংলাদেশে সিপাহি-জনতার যে বিপ্লব হয়, তা ছিল শিব গড়তে বানর গড়ার শামিল। রুশ বিপ্লবে মূল ভূমিকা ছিল সে দেশের বলশেভিক বা কমিউনিস্ট পার্টির। বাংলাদেশে সংঘটিত বিপ্লবে জাসদের মূলত তেমন ভূমিকা ছিল না। নেতারা কথিত বিপ্লবে জড়িত থাকলেও মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের রহস্যজনকভাবে দূরে রাখা হয়। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাধারণ সদস্যরা কতটা রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন ছিল।
চার.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনাসদস্যের হাতে সপরিবার নিহত হন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব। রাষ্ট্রপতি পদ দখল করেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক। মেজর পর্যায়ের অফিসারদের দাপটে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আটক রাখা হয় স্বগৃহে। আটকাবস্থা থেকে জেনারেল জিয়া কিছু একটা করার অনুরোধ পাঠান বন্ধু কর্নেল তাহেরকে। সাধারণ সেনাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় ছিলেন। এ জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় সিপাহি-জনতার বিপ্লব। বিপ্লবের নামে সাধারণ সৈনিকরা অফিসার হত্যায় মেতে ওঠেন। সৈনিকরা বন্দি অবস্থা থেকে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। তিনি তাঁকে মুক্ত করায় তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। কিন্তু একই সঙ্গে বিপ্লবের নামে অফিসার হত্যায় আঁতকে ওঠেন। তাহেরের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব দেখা দেয় শুরুতেই। সেনা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান। তাঁর ভাষায়, সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া এক সৈনিক দরবারে এসেছিলেন। মাঠে অস্ত্র উঁচিয়ে উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের ভিড়। চতুর্দিকে মুহুর্মুহু স্লোগান ‘জিয়া ভাই, জিয়া ভাই’। ঢাকা সেনানিবাসের আকাশবাতাস মুখর। পতাকাবাহী গাড়ি রাস্তায় রেখে তিনি হেঁটে সৈনিকদের ঠিক মাঝখানে চলে আসেন। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করেন, ‘তোমরা সবাই চুপ কর। আমি তোমাদের ভাই নই। আমি তোমাদের সেনাপ্রধান। সাবধানে কথা বল। সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ আমি কখনো সহ্য করব না।’ তিনি সবাইকে ব্যারাকে যাওয়ার আদেশ দেন। অস্ত্র জমা দিতে বলেন এবং চেইন অব কমান্ডে ফিরে আসতে বলেন। অবাকবিস্ময়ে আমি লক্ষ করি, মুহূর্তের মধ্যে সব কোলাহল স্তব্ধ। সৈনিকরা লাইন ধরে সুড়সুড় করে আপন আপন ইউনিটের দিকে ধাবমান। আমার কাছে সেদিন জিয়াকে মনে হয়েছিল- তিনি যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক, যার বাঁশির সুরে হ্যামিলন নগরীর সব শিশু-কিশোর যে যেখানে ছিল, তার পেছনে পেছনে ছুটেছিল....।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
ইমেইল : [email protected]